ফুসফুসের বাতাস ছেড়ে দিয়ে আবার ভারি দম নিলাম। আবার ছাড়লাম। মনে হলো কমে আসছে ভিতরের উত্তেজনা।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এগিয়ে চললাম হলওয়ে দিয়ে।
অর্ধেকটা এসেছি, এই সময় আবার কানে এল মৃদু শব্দ। আবার শোনা গেল পায়েব শব্দ। বরফের মত জমে গেলাম। কান পেতে আছি। কোথা থেকে আসছে? পিছনের দরজার কাছে। কিন্তু কে? নিশ্চয় উলফদের জানালা দিয়ে বেরোনো জনোয়ার দুটো।
নয়
দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লাম। সারা শরীর কাঁপছে।
ঢোক গিলোম। কান পেতে শুনছি দরজা ধাক্কাননার শব্দ। এখান থেকে বেরোতে হবে আমাকে!
এই বাড়িটা থেকেই বেরিয়ে যেতে হবে। ব সিডার আঙ্কেল আর জলি আন্টিকে জানাতে হবে, ভয়ঙ্কর কিছু রয়েছে পাশের বাড়িতে।
কিন্তু আমার পা দুটো যেন রবার হয়ে গেছে। এ দুটোয় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারব কিনা সন্দেহ।
কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। এক পা বাড়ালাম। তারপর আরেক পা।
রান্নাঘরে এসে দরজাটা একটানে খুলে ফেললাম। চেঁচিয়ে উঠলাম কে? কে ওখানে?
আমি, নিনা, জবাব দিল একটা ছায়ামূর্তি।
নিনা! হাঁ করে তাকিয়ে আছি। তু-তুমি এত রাতে?
হ্যাঁ। আব্বা-আম্মা বাড়িতে নেই। গেছে আমার এক আন্টির বাড়িতে, হ্যালোউইনের দাওয়াত দিতে। রাতে ফিরবে বলেও মনে হয় না। একা থাকতে ভাল লাগছিল না, তাই চলে এলাম। একটু থেমে জিজ্ঞেস করল নিনা, কিন্তু তোমার গলা এমন কাঁপছে কেন?
তোমাকে দেখে আমি ভাবলাম… বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। কথাগুলো যেন আটকে গেল গলায়।
কী ভাবলে?
না, কিছু না!
কিছু তো বটেই। কী হয়েছে?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নিনা, আমার ক্যামেরাটা কোথায় জানো? সারা বাড়ি খুঁজেও পাচ্ছি না…
না, জানি না! গুঙিয়ে উঠল নিনা। বনের ভিতর ফেলে আসনি তো?
নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেল আমার। কী জানি! হবে হয়তো…
পেটের ভিতর এক ধরনের অস্বস্তিকর খামচে ধরা অনুভুতি হচ্ছে।
টনি আর রজার চলে যাবার সময় তোমার হাতেই ছিল, দেখেছি, নিনা বলল। কিন্তু এখানে ফেরার পর আর দেখেছি কিনা মনে করতে পারছি না।
হুঁ! বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। ওটা আনতে হবে, নিনা। সারারাত বনের ভিতর ফেলে রাখতে পারব না।
না না! চেঁচিয়ে উঠল নিনা। আজ রাতে ওই বনের ভিতর যেয়ো না।
আমাকে যেতেই হবে!
রাতের বেলা ওই বন মোটেও নিরাপদ নয়। ভীষণ বিপজ্জনক।
ঘুরে দাঁড়িয়ে হলওয়ে ধরে ছুটলাম। আমার ঘরে ঢুকে জ্যাকেট গায়ে দিলাম। আলমারিতে একটা টর্চ পেলাম। সুইচ টিপে দেখলাম। ব্যাটারি আছে। আলো বেশ উজ্জ্বল।
বেরিয়ে এসে সিঁড়ির গোড়া থেকে নিনাকে বললাম, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসছি।
না না, প্লিজ, রবিন। ককিয়ে উঠল নিনা। আমার কথা শোনো! আজ রাতে বনের মধ্যে যেয়ো না!
কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। এত দামি ক্যামেরাটা নষ্ট হতে দিতে পারি না।
কী যেন ভাবল নিনা। ঠিক আছে, একটু অপেক্ষা করো। আমি জ্যাকেটটা পরে আসি।
কিন্তু বনের ভিতর পড়ে থেকে দামি ক্যামেরাটা নষ্ট হতে দেবার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। তোমার আসতে দেরি হবে। ততক্ষণ সহ্য হবে না আমার। তা ছাড়া দুটো বাড়িকেই খালি ফেলে সবার চলে যাওয়া উচিত হবে না। তুমি তোমাদের বাড়ি পাহারা দাও। এ বা দিকেও খেয়াল রেখো। আমি যাব আর আসব।
বাইরে বেরিয়ে পাল্লার ছিটকানি তুলে দিলাম। নেমে এলাম সিঁড়ির নীচে।
চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে যেন সব কিছু।
দশ
বাড়ির পাশ ঘুরে দৌড়ে চললাম পিছন দিকে।
হঠাৎ করেই ভারি কালো মেঘে ঢেকে দিল চাঁদ, যেন আমাকে যন্ত্রণা দেয়ার জন্যই।
রাতের বাতাস খুবই ঠাণ্ডা। ভেজা ভেজা। দৌড়াতে দৌড়াতেই জ্যাকেটের জিপার তুলে দিলাম।
উলফদের বাড়ির দিকে ফিরে তাকালাম। কাউকে চোখে পড়ল না। পিছনের জানালাটা খোলা। কিন্তু বাড়িটা পুরোপুরি অন্ধকার। একটা আলোও নেই কোথাও।
ভারি শিশিরপাতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে ঘাস। কপালে ঠাণ্ডা ফোঁটা পড়ল।
বৃষ্টি।
ক্যামেরাটার কথা ভেবে গুঙিয়ে উঠলাম। ভোলা জায়গায় পড়ে আছে নিশ্চয়। পানি পড়লে আমার এত দামি ক্যামেরাটা যাবে! বৃষ্টি আসার আগেই ওটা খুঁজে বের করতে হবে।
আমার পায়ের কাছে হুটোপুটি করছে ছোট ছোট জানোয়ার। থেমে গেলাম।
না। জানোয়ার নয়। মরা পাতা। জোর বাতাসে অন্ধকারে ঘাসের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।
মাথা নিচু করে একটা ডালের তলা দিয়ে এসে বনে ঢুকলাম। পুরানো গাছগুলো থরথর করে কাঁপছে, মড়মড় শব্দ করছে।
দূর থেকে ভেসে আসা পেঁচার ডাক আঙ্কেল ও আন্টির কথা মনে করিয়ে দিল আমাকে। ক্যামেরা হাতে বনের ভিতরেই আছেন কোথাও দুজনে। ভয় লাগছে, তাদের সামনে পড়ে যাব না তো?
বনের ভিতরের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে এগিয়ে চললাম। বৃষ্টির আরেকটা বড় ফোঁটা পড়ল কপালে। মাটিতে ফোঁটা পড়ার টুপুর-টাপুর শব্দ হচ্ছে।
পুরানো, ঝুঁকে থাকা গাছটা নজরে আসতে থেমে গেলাম। বিকেল বেলা এই গাছটারই ছবি তুলেছিলাম। টর্চের আলো ফেললাম গাছের গোড়ায়।
যাক, পথ হারাইনি, ঠিকমতই এসেছি, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললাম। ৪ পড়ে থাকা একটা গাছের ডাল ডিঙিয়ে এলাম। বাতাসের বেগ বাড়ছে। গাছের পাতায় হুসহুস শব্দ হচ্ছে। নড়ছে জোরে জোরে। থেকে থেকেই ডেকে উঠছে দূরের পেঁচাটা।