মৃদু হেসে বললাম, আমিও ভাবছি জলদস্যুই সাজব।
বাটির বাকি সুপটুকু খেয়ে শেষ করলাম।
তখনও কল্পনাই করতে পারিনি, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আকাশের যখন মাঝখানে চলে যাবে চাঁদটা, কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পাব।
সাত
ডিনার শেষ হতেই উঠে দাঁড়াল নিনা। বলল, আমি যাই, অনেক দেরি করে ফেলেছি। মা বকবে।
তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেল ও।
আমি আমার ছোট্ট বেডরুমটায় এসে ঢুকলাম।
কাপড় বদলালাম। পরনের কাপড়গুলো ঢুকিয়ে দিলাম ড্রেসারের ভিতর। যতটা সম্ভব গোছগাছ করে রাখতে চাইলাম ছোট্ট ঘরটাকে, নইলে হাঁটাচলার জায়গা থাকবে না।
ডেস্কে বসে মা-বাবাকে চিঠি লিখলাম। জানালাম, আমি ভাল আছি। লিখলাম, গ্রীন হিলসে ফিরে প্রচুর ভাল ভাল ছবি আমি দেখাতে পারব ওদের। কি চিঠি লেখা শেষ হলো। এখনও ঘুম পাচ্ছে না। তবু শুয়ে পড়াই ভাল।
পাজামা নেয়ার জন্য আলমারির দিকে এগোলাম। কিন্তু থেমে গেলাম জানালার বাইরে চোখ পড়তে। পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
তাকিয়ে আছি কমলা আলোর দিকে।
উলফদের বাড়ির একটা জানালায় দেখা যাচ্ছে ওই আলো!
দুটো গাছের মাঝখান দিয়ে আসাতে কাঁপা কাঁপা দেখাচ্ছে আলোটা।
বাতাসে কাঁপছে গাছগুলোর পাতা। ফ্যাকাসে কমলা আয়তাকার আলো দেখা যাচ্ছে বাড়ির পিছন দিকের নীচতলার একটা ঘরের জানালায়।
জানালাটা কি বেডরুমের?
আমার ঘরের জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। কমলা আয়তাকার আলোটার ওপাশে কী আছে দেখার : চেষ্টা করছি।
উলফদের কাউকে কি দেখতে পাব? দম আটকে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।
জানালার ওপাশে ছায়া নড়তে দেখলাম। ধূসর একটা ছায়ামূর্তি ধরা পড়ল কমলা আলোয়।
মানুষের ছায়া?
বুঝতে পারলাম না।
নড়ে উঠল ছায়াটা। একটা জন্তু, মনে হলো আমার।
তারপর মনে হলো, না না, মানুষই।
মিস্টার উলফ নাকি?
আরও জোরে নাক চেপে ধরলাম জানালার কাঁচে। আরও ভাল করে দেখতে চাইলাম।
উঁহু, মানুষ না।
বড় কুকুর?
নাকি মানুষই?
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না।
জানালা থেকে সরে গেল ছায়াটা।
তারপর তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল।
কুৎসিত, ভয়ানক শব্দ। আধা-মানুষ, আধা-জানোয়ারের। এ রকম শব্দ আগে কখনও শুনিনি।
মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল আমার।
আবার শোনা গেল সেই ডাক। ঘন হয়ে গেল আমার নিঃশ্বাস।
জানালার কাছে ফিরে এল ছায়াটা। এখন আর মানুষের মত লাগছে না। মাথা হেলিয়ে দিয়ে, চোয়াল ফাঁক করে আবার ডেকে উঠল ওটা। নিশ্চয় ভয়ঙ্কর কোনও জানোয়ার।
ওই জানোয়ারটার ছবি তুলতে হবে।
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। মাঝখানের ছোট্ট পরিসর পেরিয়ে এসে প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়লাম ডেস্কের ওপর।
ক্যামেরার জন্য হাত বাড়ালাম।
কিন্তু কোথায় ওটা?
আট
ডেস্কের ওপর পাগলের মত হাতড়ে বেড়াচ্ছে আমার আঙুলগুলো।
কিন্তু ক্যামেরাটা পেলাম না।
সারা ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগল আমার দৃষ্টি। সব কিছুই জায়গামত রয়েছে। ড্রেসারটাতে রাখলাম নাকি?
না, ওখানেও নেই।
হাঁটু গেড়ে বসে বিছানার তলায় উঁকি দিলাম।
নেই।
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলাম আলমারিটার কাছে। টান দিয়ে। দরজা খুললাম। খুঁজে দেখলাম ভিতরে। নেই ওটা।
আবার শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার। নেকড়ের ডাকের মত।
পরক্ষণে শোনা গেল আরেকটা একই রকম ডাক। একসঙ্গে ডেকে উঠল যেন দুটো নেকড়ে। সাইরেনের শব্দের মত তীক্ষ্ণ হয়ে এসে ঘুরতে থাকল আমার ঘরের ভিতর।
জানালা খোলার শব্দ শুনলাম। ধুপ করে ভারি একটা শব্দ। মাটিতে পায়ে পড়াম। মাটিতে লাফিয়ে পড়ার। ঘোঁতঘোঁত শোনা গেল। তারপর হাঁটার শব্দ। ঠিক আমার ঘরের বাইরে।
জানালার দিকে ছুটলাম। বুকের মধ্যে বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ডটা। বাইরে তাকালাম। আসতে দেরি করে ফেলেছি। কাউকে চোখে পড়ল না। নিভে গেছে উলফদের জানালার কমলা আলো। আবার অন্ধকার হয়ে গেছে বাড়িটা।
থিরথির কাঁপছে গাছের ডাল। নীল-কালো আকাশের পটভূমিতে কালো দেখাচ্ছে। পাতাগুলো চিকচিক করছে। উজ্জ্বল জ্যোত্সায় যেন নেয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম। বুকের কাঁপুনি বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা করছি। কান পেতে আছি তীক্ষ্ণ চিৎকার ও ভারি পায়ের শব্দ শোনার আশায়।
শুধুই নীরবতা এখন। আবার মনে পড়ল ক্যামেরাটার কথা।
জানালার কাছ থেকে যেন জোর করে ঘোরালাম নিজেকে। ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে হলওয়ে পেরিয়ে ছুটলাম লিভিং রুমের দিকে। ভুল করে ক্যামেরাটা ওখানে রেখে আসিনি তো?
না। লিভিং রুমেও নেই। রান্নাঘরে খুঁজলাম। সেখানেও নেই।
জুলি আন্টি! সিডার আঙ্কেল! ডাক দিলাম। জবাব এল না।
হল ধরে দৌড়ে চললাম। আমার ঘরটা পেরিয়ে এলাম। পেরিয়ে এলাম বাথরুম ও গরম কাপড় রাখার বড় আলমারিটা। হলের শেষ প্রান্তে তাদের ঘর। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ক্যামেরাটা দেখেছেন?
ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললাম তাদের বেডরুমের দরজা। অন্ধকার ঘর। ছবি ডেভেলপ করার ঝাঁঝাল রাসায়নিক গন্ধ নাকে ঢুকল। তাতে মনে পড়ল, বনের ভিতর নিশাচর জীবের ছবি তুলতে বেরিয়েছেন দুজনে।
ঘরে আমি একা।
ভারি দম নিলাম। নিজেকে বোঝালাম, শান্ত হও রবিন। কোন ভয় নেই। এখানে তুমি নিরাপদ।
মাথা ঠাণ্ডা করো। তা হলেই খুঁজে পাবে ক্যামেরাটা। ঘরেই আছে ওটা। মাথা গরম করে ফেলেছ বলে দেখতে পাচ্ছ না।