ভয় পেলে নাকি? আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল একজন। উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে চোখ। গায়ে গাঢ় বাদামী রঙের সোয়েটার, পরনে কালো ডেনিম জিনস। গলায় জড়ানো লম্বা একটা গোলাপি রঙের মাফলার।
তা তো পেয়েছিই, ব্যঙ্গ করে জবাব দিল নিনা। যা চেহারা তোমাদের। দুঃস্বপ্নে দেখার মত!
দ্বিতীয় ছেলেটার পরনে উলের কাপড়ের ঢোলা শার্ট। পরনের খাকি প্যান্টটা এত লম্বা, ঝুল মাটিতে গড়াচ্ছে। মাথা পিছনে হেলিয়ে আবার নেকড়ের মত তীক্ষ্ণ হাঁক ছাড়ল।
আমার দিকে ফিরল নিনা। ওরা আমার ক্লাসে পড়ে। ওর নাম টনি, লাল মাফলারওয়ালা ছেলেটাকে দেখাল ও। আর এর নাম রজার।
তুমি আসবে, নিনা আমাদের বলেছিল, হাসিমুখে বলল টনি।
তা উলফ লেক কেমন লাগছে? ভুরু নাচাল রজার।
কি কালো চোখ মেলে দুজনেই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যেন আমি একটা বিচিত্র প্রাণী।
মাত্র তো এলাম, জবাব দিলাম। কিছুই না দেখে কী করে বলি উলফ লেক কেমন? 18
চোখে চোখে তাকাল দুজনে। আমার দিকে ফিরে টনি বলল, ঠিক, সবই দেখা দরকার। বনের কিছু নিয়ম-কানুন এখনই জেনে নাও।
যেমন? প্রশ্ন করলাম।
আমার পায়ের দিকে আঙুল তুলে টনি বলল, বিছুটি গাছের ওপর কখনও দাঁড়াতে নেই।
চট করে সরে গিয়ে মাটির দিকে তাকালাম।
হেসে উঠল ওরা দুজন।
বিছুটি-টিছুটি কিছু নেই। আমার সঙ্গে মজা করেছে টনি।
প্রচণ্ড রাগ হলো। কিন্তু লাগতে গেলে পারব না ওদের সঙ্গে। বাধ্য হয়ে চুপ করে রইলাম। ওই মুহূর্তে মুসার কথা ভেবে মনটা খারাপ লাগল। ইস্, মুসা থাকলে এভাবে আমার সঙ্গে শয়তানি করে পার পেত না ছেলেগুলো।
তোমরা হলে গে বিড়ালের বমি। আমার সঙ্গে ছেলে দুটোর আচরণে নিনাও রেগে গেছে।
তা হলে এই বমি দিয়ে নাস্তা করে ফেলো! টনি জবাব দিল।
হেসে উঠল দুই পাজি। জোরে চাপড় মারল একে অন্যের পিঠে।
হতাশার ভান করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিনা। আহা, কী রসিকতা! কিন্তু এখন তো হাসি আসছে না, পরে চেষ্টা করে দেখব হাসা যায় কি না।
আবার নেকড়ের মত ডেকে উঠল ছেলে দুটো।
হঠাৎ করে আমার ক্যামেরার দিকে হাত বাড়াল টনি। দেখি?
না, সরে গেলাম। খুব দামি জিনিস। কাউকে এটা ধরতে দিই না।
কত দামি! মুখ বাঁকাল টনি। কীসের তৈরি? সোনার। দেখি তো। ধরার জন্য আবার থাবা মারল ও।
আমার ছবি তোলো, দুই আঙুল মুখে পুরে ঠোঁটের দুই কোণ টেনে ধরল রজার, জিভ বের করে দিল।
হ্যাঁ, এবার চেহারাটার অনেক উন্নতি হয়েছে, নিনা বলল।
আমার ছবি তোলো! আবার বলল রজার।
আহ, কী শুরু করলে তোমরা! ধমকে উঠল নিনা। ছাড়োনা ওকে!
দুঃখ পাওয়ার ভান করল রজার। আমার ছবি তোলে না কেন?
জন্তু-জানোয়ারের ছবি তোলে না ও! নিনা বলল।
হেসে উঠল টনি। আমার হাত থেকে ক্যামেরাটা কেড়ে নিল।
আরে, আরে! আমার ক্যামেরা দাও! নেয়ার জন্য থাবা মারলাম। ধরতে পারলাম না।
রজারের দিকে ক্যামেরাটা ছুঁড়ে দিল টনি। রজার ওটা নিয়ে নিনার ছবি তোলার ভান করল। চেঁচিয়ে উঠল, হায় হায়, তোমার চেহারা দেখেই ক্যামেরার লেন্স ফেটে গেল!
আমি তোমার নাক ফাটিয়ে দেব! নিনা জবাব দিল।
ওটা সত্যিই দামি ক্যামেরা, আমি বললাম। নষ্ট হলে…
থাবা দিয়ে রজারের হাত থেকে ক্যামেরাটা কেড়ে নিয়ে আমার হাতে ___নিনা।
ক্যামেরাটা শক্ত করে ধরলাম, থ্যাংকস।
ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে আমার দিকে এগোতে শুরু করল ছেলে দুটো। চোখের তারা জ্বলছে। ওদের কঠিন চেহারা, চোখের শীতল দৃষ্টি আবার আমাকে বুনো জানোয়ারের কথা মনে করিয়ে দিল।
ওকে ছাড়ো বলছি। চাবুকের মত শপাং করে উঠল নিনার কণ্ঠ।
না, কিছু করছি না তো, জবাব দিল রজার। এমনি একটু মজা করছিলাম। ওর ক্যামেরা নষ্ট করব না।
আমিও কিছু মনে করিনি, ক্যামেরাটা সরিয়ে রাখলাম ওর নাগালের বাইরে।
অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল রজার। পাতার ফাঁক দিয়ে আমি শুধু ধূসরতা দেখলাম। দেরি হয়ে যাচ্ছে, বিড়বিড় করল ও।
হাসি মলিন হয়ে গেল টনির। চলো, পালাই। দ্রুত দৃষ্টি ঘুরে এল একবার চারপাশের বনে। ছায়া ঘন হচ্ছে। ঠাণ্ডা বাড়ছে।
শুনলাম, কী একটা খেপা জানোয়ার নাকি বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মৃদুস্বরে বলল রজার।
রজার, তুমি থামবে! গুঙিয়ে উঠল নিনা।
না, সত্যি বলছি, রজার বলল। একটা হরিণের মাথা দেখে এলাম। স্রেফ টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।
মাথাটা আমিও দেখেছি, টনি বলল। মলিন হয়ে আসা আলোতেও ওর কালো চোখে আতঙ্ক দেখা গেল। সত্যিই বলছে, ভাঁড়ামো করছে না আর এখন। ভয়ঙ্কর।
হরিণের চোখ দুটো আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, রজার বলল। কাটা গলায় পোকা কিলবিল করছে।
ওয়াক! দুই হাতে মুখ ঢেকে যেন বমি ঠেকাল নিনা। সব বানিয়ে বলছ, তাই না?
না না, সত্যি। মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকাল টনি। পূর্ণিমা এসে গেছে। আর জানোই তো পূর্ণিমার সময় আজব আজব জানোয়ারেরা বেরিয়ে আসে তাদের গোপন আস্তানা থেকে। মৃদু স্বরে কথা বলছে ও, প্রায় ফিসফিস করে। বিশেষ করে হ্যালোউইনের রাতে, চাঁদটা যখন পুরো গোল হয়ে যায়।
গায়ে কাঁটা দিল আমার। ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল। হঠাই ঠাণ্ডা হয়ে এল হাত-পা।
মাটিতে পড়ে থাকা হরিণের মাথাটার কথা ভাবলাম।
নিষ্প্রাণ, কালো চকচকে চোখ জোড়া আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম কল্পনায়।
হ্যালোউইনে কী সাজবে? নিনাকে জিজ্ঞেস করল টনি।