কিন্তু পর্দাগুলো…
আমি তো বলেছি ওরা আজব মানুষ, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল নিনার কণ্ঠ। জানালার কাছে তোমাকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখলে ভীষণ রেগে যাবে। চলে এসো, রবিন।
পিছিয়ে এলাম জানালার কাছ থেকে। বেরিয়ে থাকা একটা পচা তক্তায় পা বেধে আরেকটু হলেই উল্টে পড়ে যাচ্ছিলাম। নেমে এলাম নীচে।
তুমি বনে যাবে, নাকি যাবে না? অধৈর্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল নিনা।
সরি, চলো। নিনার কাছে এসে বললাম, উলফদের ব্যাপারে যা যা জানো বলল আমাকে। যত ভয়ালই হোক, আমি শুনব।
না, বলব না, চাপা খসখসে কণ্ঠে জবাব দিল নিনা। প্রায় দৌড়ে চলল সিডার আঙ্কেলের বাড়ির পিছন দিকে। হলুদ আর লাল রঙের পাতাওয়ালা গাছগুলোতে শেষ বিকেলের ছায়া।
প্লিজ! বললাম আমি।
বলব, তবে কয়েক দিন পরে, জবাব দিল নিনা। পূর্ণিমা চলে গেলে।
এখন বললে অসুবিধে কী?
না, এখন বলা যাবে না।
নিনার কথায় অবাক হলাম। ঘটনাটা কী? এখানে সবাই এমন রহস্যময় আচরণ করছে কেন? আমার আঙ্কেল-আন্টি, নিনা, সবাই যেন আমার কাছে কী লুকোতে চাইছে।
নিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিকে তাকালাম। মস্ত একটা গোল চাঁদ উঠেছে গাছের মাথায়, যদিও দিনের আলো মিলিয়ে যায়নি এখনও।
কেঁপে উঠল নিনা। পূর্ণিমাকে এখানে সবাই ভয় পায়। চলে। যাওয়ার পর শান্তি।
কেন? পূর্ণিমা এলে ক্ষতিটা কী?
উলফদের বাড়ির দিকে ফিরে তাকাল নিনা। জবাব দিল না।
কী হলো? জবাব দাও না কেন?
ভয় লাগে। পূর্ণিমা যাক, তারপর।
কেন, পূর্ণিমা না গেলে ক্ষতি কী?
আছে, ক্ষতি আছে।
তা হলে তোমার ক্ষতি হচ্ছে না কেন?
আমি পূর্ণিমার অনেক আগেই এসেছি। অমাবস্যার সময়। তখন শুনেছি সব। এখন বললে ওরা শুনে ফেলতে পারে।
ওরা কারা?
জবাব দিল না নিনা।
.
বনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে নামছে যেন ফিকে হয়ে আসা রোদের আলো। মাটিতে নেমে ছোট ছোট সোনালি বিন্দু হয়ে ঝিলমিল করছে। মরা পাতা আর শুকনো ডালে আমাদের পা পড়ে শব্দ হচ্ছে।
বুড়ো একটা গাছ খুঁজে বের করলাম আমরা। প্রচুর গাঁটওয়ালা কাণ্ড গাছটার। বুড়ো মানুষের মত নুয়ে পড়েছে। বয়স্ক মানুষের মতই কুঁচকে গেছে ছাল। মোটা মোটা ধূসর শিকড়ের গোড়া বেরিয়ে পড়েছে মাটি থেকে।
কী সাংঘাতিক! না বলে পারলাম না। কেস থেকে টেনে বের করলাম ক্যামেরাটা।
হাসল নিনা। গাছের ছবি তুলবে?
হ্যাঁ। গাছটার চেহারা দেখেছ! এক্কেবারে জ্যান্ত মনে হচ্ছে।
আবার হেসে উঠল নিনা। গাছ তো জ্যান্তই হয়।
আসলে, আমি বলতে চাইছি ভূতুড়ে, বিড়বিড় করে বললাম।
ঝুঁকে পড়া পুরানো গাছটার ছবি তুলতে শুরু করলাম। পিছিয়ে এসে সামান্য কাত হয়ে থাকা একটা বার্চ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম, যাতে হাত দুটো স্থির রাখতে পারি। গাছটাকে এমনভাবে ফ্রেমবন্দি করতে চাইলাম যাতে ওটাকে মানুষের মত দেখায়।
ওই অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলার পর গাছটাকে ঘিরে চক্কর দিতে থাকলাম। ওটার খাঁজ, ছালের ভাঁজ, সব কিছু দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম কোন অ্যাঙ্গেলে তুললে অন্যরকম ছবি উঠবে, যেটাকে আলাদা কিছ মনে হবে। একটা ডাল লম্বা হয়ে গিয়ে মাটি ছুঁয়েছে মনে হচ্ছে একজন মানুষ কাত হয়ে আছে
এই অ্যাঙ্গেল থেকে একটা ছবি তুললাম।
এরপর হাঁটু গেড়ে বসলাম। শিকড়গুলোকে মনে হলো মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আছে সরু সরু পা। এই অ্যাঙ্গেল থেকে তুললাম কয়েকটা ছবি।
মৃদু গুঞ্জন শুনে মুখ ফিরিয়ে তাকালাম। ছোট একটা গাছে ফুলের ওপর উড়ছে একটা হামিংবার্ড। খুদে পাখিটাকে ফ্রেমবন্দি করার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু পাখিটা অতিরিক্ত ক্ষিপ্র। আমি শাটার টেপার আগেই উড়ে চলে গেল।
উঠে দাঁড়ালাম। মাটিতে বসে আছে নিনা। দুই হাতে শুকনো পাতা কচলাচ্ছে। মুড়মুড় করে ভেঙে ডো গুড়ো হচ্ছে পাতাগুলো।
গরমকাল যে চলে গেছে ওই পাখিটা কি জানে না? বিড়বিড় করলাম।
শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে নিনা। আমার কথা যেন। ভুলেই গেছে। আঁ, কী বললে? ও, পাখি। সরি, রবিন, আমি পাখিটাকে দেখিনি। উঠে দাঁড়াল ও।
ওদিকে কী? গভীর বনের দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করলাম।
উলফ লেক, জবাব দিল নিনা। আরেক দিন নিয়ে যাব। এখন চলো, বাড়ি যাই। সূর্য ডোবার আগেই বন থেকে বেরোনো দরকার।
হঠাৎ করেই মনে পড়ল, বনে নেকড়ে থাকার কথা বলেছিলেন সিডার আঙ্কেল। আর নেকড়ের নামেই উলফ লেকের নামকরণ হয়েছে।
নেকড়েরা এখন আর থাকে না, তাই না? আমি বললাম, ওখান থেকে চলে গেছে।
মাথা ঝাঁকাল নিনা। হ্যাঁ, চলে গেছে।
তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার শোনা গেল এ সময়। খুব কাছে থেকে। আমার পিছনে। অনেকটা নেকড়ের ডাকের মত।
চমকে উঠলাম।
পাঁচ
পিছাতে গিয়ে বার্চ গাছটায় ধাক্কা খেলাম। গাছের গায়ে বাড়ি খেল ক্যামেরাটা। তবে হাত থেকে পড়ল না।
নিনা… ওর দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম। বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেছে নিনার চোখ।
ও কিছু বলার আগেই ঝোপের ভিতর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল দুটো ছেলে। মাথা পিছনে হেলিয়ে চিৎকার করে উঠল নেকড়ের মত।
ও, তোমরা! বলে উঠল নিনা। মুখ বাঁকাল বিরক্তিতে।
দুজনেই ওরা স্বাস্থ্যবান, নিয়মিত ব্যায়াম করে মনে হলো। হয়তো স্কুলের ফুটবল, ভলিবল টিমেরও সেরা খেলোয়াড়। দুজনেরই কালো চুল, বাদামী চোখ। আমার দিকে তাকাল। ওদের দুই চোখে, যেন নেকড়ের মতই ক্ষুধার্ত দৃষ্টি।