আমি কিংবা জুলি আন্টি কিছু বলার আগেই পিছনের দরজায় টোকার শব্দ হলো। জুলি আন্টি খুলে দিলেন। ঘরে ঢুকল একটা মেয়ে। নিশ্চয় নিনা। গতকাল; লম্বা, হালকা-পাতলা দেহ ওর। আমার চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা হবে। জুলি আন্টি ঠিকই বলেছেন। মেয়েটা সুন্দরী। কালো চুল, জলপাই রঙের চোখ, আর চমৎকার হাসি। ঢিলেঢালা সবুজ রঙের একটা সোয়েটার গায়ে দিয়েছে। পরনে কালো প্যান্ট।
আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন জুলি আন্টি। দুজনেই হাই বললাম দুজনকে। নতুন কারও সঙ্গে পরিচিত হতে গেলে বিব্রত বোধ করি আমি, তবে মেয়েটার মধ্যে কোন আড়ষ্টতা নেই।
জুলি আন্টি নিনাকে স্যাণ্ডউইচ খেতে বললেন।
না, থ্যাংকস, জবাব দিল নিনা, আমি খেয়ে এসেছি।
রবিনকে আনতে বাস স্টপেজে গিয়েছিলাম, নিনার দিকে তাকিয়ে বললেন জুলি আন্টি। সেজন্যেই লাঞ্চ খেতে দেরি হলো।
স্যাণ্ডউইচ তুলে নিয়ে কামড় বসালাম। খাওয়া শুরু করার আগে বুঝতে পারিনি কতটা খিদে পেয়েছে।
নিনা, রবিনকে নিয়ে বনের ভিতর থেকে ঘুরে এসো না? সিডার আঙ্কেল বললেন।
উলফ লেকের বন কী জিনিস দেখিয়ে আনো। বড় সবাই হাসল, আমি বাদে। এর মধ্যে রসিকতাটা কোনখানে বুঝতে পারলাম না।
প্রচুর ফিল্ম নিয়ে এসেছি, নিনাকে বললাম। সব শেষ করব এখানে। নিজের অজান্তেই চেপে ধরলাম ক্যামেরা, কেসটা।
ভালই হবে, নিনা বলল। শরতের পাতা যা রঙ ধরেছে না, উফ।
সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টিকে গুডবাই জানিয়ে সামনের দরজার দিকে এগোলাম আমরা। শেষ বিকেলের লাল সূর্যটা গাছের মাথা ছুঁয়েছে। পড়ন্ত রোদ ঘাসের ওপর আমাদের লম্বা ছায়া ফেলল।
জন এই এই, আমার ছায়া মাড়িয়ে দিচ্ছ তো তুমি! হেসে উঠল নিনা। পায়ের ছায়া দিয়ে লাথি মারল আমার ছায়াটাকে। এ
আউ! করে চেঁচিয়ে উঠে ব্যথা পাওয়ার ভান করলাম। ওর ছায়াকে ঘুসি মারলাম আমার হাতের ছায়া দিয়ে।
লাথি দিয়ে, ঘুসি মেরে, খানিকক্ষণ ছায়ায় ছায়ায় যুদ্ধ চালালাম আমরা। দুই পায়ে লাফিয়ে উঠে ওর ছায়াটা নেমে এল আমার ছায়ার ওপর। মাটিতে পড়ে গিয়ে মরে যাওয়ার ভান করলাম।
দুই সেকেণ্ড পড়ে থেকে উঠে বসলাম। হেসে গড়িয়ে পড়ছে নিনা। মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে ওর লম্বা চুল।
দ্রুতহাতে কেস থেকে ক্যামেরাটা বের করে ওর একটা ছবি তুলে ফেললাম।
হাসি থেমে গেল ওর। মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল। আমার ছবি তুললে কেন?
তলতে ইচ্ছে করল, জবাব দিলাম।
উঠে দাঁড়ালাম। আবার ক্যামেরাটা তুলে নিলাম চোখের সামনে। উলফদের বাড়ির দিকে ঘুরলাম। কয়েক পা এগোলাম বাড়িটার দিকে, ভিউফাইণ্ডারের ফ্রেমে নিয়ে আসার জন্য।
আমার হাত চেপে ধরল নিনা।
আরে! চেঁচিয়ে উঠলাম।
ছবি তুলো না! খসখসে স্বরে আমাকে সাবধান করে দিল নিনা। ওরা দেখে ফেলবে।
তাতে কী? শাটার টিপে দিলাম। সামনের অন্ধকার জানালায় কিছু একটা নড়তে দেখে গায়ে কাঁটা দিল।
কেউ কি তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে?
ক্যামেরা নামালাম।
এসো, আমাকে টান দিল নিনা। বনে যাবে, নাকি যাবে না?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি উলফদের বাড়িটার দিকে। জানো, ওই বাড়িটার কথা জিজ্ঞেস করায় ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন সিডার আঙ্কেল। ঘটনাটা কী, বলো তো?
সত্যিই জানি না, আমার হাতটা ছেড়ে দিল নিনা। ইদানীং উলফরা খুব অদ্ভুত আচরণ করছে। একটিবারের জন্যে বাড়ির বাইরে বেরোয় না। অথচ আগে এমন ছিল না। জানালায় মাঝে মাঝে অদ্ভুত ছায়া দেখা যায়, তা-ও রাতের বেলা। নানা রকম ভয়াল গল্প শোনা যায় ওদের ব্যাপারে।
ভয়াল গল্প? কী গল্প?
জবাব দিল না নিনা। দেবে যাওয়া ভাঙা বারান্দা, ছাতের ধূসর। মলিন টালিগুলোর দিকে তাকিয়ে সরু হয়ে এল ওর চোখের পাতা। চলো, এখান থেকে চলে যাই।
বাড়ির পাশ দিয়ে প্রায় দৌড়ে চলল ও, পিছন দিকে। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে গেলাম না। বরং ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম উলফদের বাড়িটার দিকে। সামনের চত্বরের বড় বড় ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে পা রাখলাম।
দাঁড়াও! কোথায় যাচ্ছ তুমি? চেঁচিয়ে ডাকল নিনা।
ক্যামেরাটা কোমরের কাছে ধরে সোজা বাড়িটার দিকে এগোলাম। ওর প্রশ্নের জবাব দিলাম, দেখতে।
রবিন, প্লিজ। নিনা বলল। উলফরা আমাদের মত ছেলেমেয়েদের দেখতে পারে না। ওদের বাড়ির কাছে যাওয়াটা পছন্দ করে না। প্লিজ, চলে এসো। বনে যাই আমরা।
ফিরে তাকালাম নিনার দিকে। কী হয়েছে, নিনা? এত ভয় পাচ্ছ কেন?
ও কিছু বলার আগেই ভাঙা বারান্দার পচা কাঠের তক্তায় সাবধানে পা রাখলাম আমি। সামনের জানালাটার দিকে তাকালাম।
যে অস্তগামী সূর্যের লাল আলো ভরে দিয়েছে যেন জানালার কাঁচ। একটা মুহূর্তের জন্য মনে হলো আগুন ধরে গেছে জানালাটায়।
চোখ সরাতে বাধ্য হলাম।
কাঁচ থেকে রোদ সরে গেলে আবার তাকালাম জানালাটার দিকে। নিজের অজান্তেই অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।
জানালার ওপাশের পর্দা দেখা যাচ্ছে। ছেঁড়া। ফালি ফালি করে ফেলা হয়েছে। ও নখ দিয়ে চিরে ওই অবস্থা করেছে যে কোনও ভয়াল জানোয়ার।
চার
নিনা, পর্দার অবস্থা দেখে যাও, ডেকে বললাম। চোখ সরাতে পারছি না ছেঁড়া পর্দা থেকে।
ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে ও। সিডার আঙ্কেলের বাড়িটার দিকে পিছন করে। দুই হাত বুকের ওপর ভাঁজ করা। জবাব দিল, না, আমি দেখতে চাই না।