যেহেতু ম্যাপে লিখে ফেলা হয়েছে, রসিকতা করতে চাইলেন আন্টি।
এখানকার বনে নাকি প্রচুর নেকড়ে ছিল একসময়, তাই ওই নাম, মৃদুকণ্ঠে জানালেন সিডার আঙ্কেল।
স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন জুলি আন্টি, সত্যি কথাটা রবিনকে বলে দিলেই পারো।নভীর
চুপ থাকো! হিসিয়ে উঠলেন আঙ্কেল। কেন শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছ ওকে? o প্যাসেঞ্জার সিটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন জুলি আন্টি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলাম আমরা।
মোড় নিল গাড়ি। ছোট একটা গোলাকার জায়গা চোখে পড়ল। চক্রের ভিতর পাশাপাশি তিনটে বাড়ি। তার ওপাশে ছড়িয়ে আছে বন।
ওই যে আমাদের বাড়ি, মাঝখানেরটা, হাত তুলে দেখালেন। সিডার আঙ্কেল।
তাকিয়ে রইলাম। ছোট একটা চারকোনা সাদা বাড়ি। সামনে সুন্দর করে ছাঁটা লন। লম্বা, নিচু, র্যাঞ্চ-স্টাইলের আরেকটা বাড়ি রয়েছে সাদা বাড়িটার ডান পাশে। ধূসর দেয়াল। জানালাগুলো কালো রঙ করা।
বাঁ পাশের বাড়িটা বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড়ে প্রায় ঢাকা পড়েছে। বাড়ির সামনে লম্বা লম্বা ঘাস। বড় একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়ে ওই বাড়িতে গাড়ি ঢোকার রাস্তাটা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।
মাঝের বাড়িটার ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢোকালেন সিডার আঙ্কেল।
ছোট বাড়িতে থাকতে আমাদের অসুবিধে হয় না, মাত্র দুজন তো মানুষ।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন জুলি আন্টি। হ্যাঁ। তা ছাড়া এক জায়গায় তো বেশিদিন থাকতে পারি না, সব সময় শুধু ঘুরে বেড়ানো, বড় বাড়ি দিয়ে কী হবে।
আবার আমার দিকে ঘুরলেন তিনি। পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে থাকে, আমাদের পড়শি। ডানের র্যাঞ্চ-স্টাইল বাড়িটা দেখালেন। বাড়িতে থাকে ও। বারো বছর বয়েস, তোমার বয়েসী, তাই না?
মাথা ঝাঁকালাম।
ওর নাম নিনা। খুব সুন্দরী। স্বভাবও ভাল। ওকে বন্ধু বানাতে পারবে। তা হলে আর একা একা লাগবে না।
কোন ছেলে নেই? জিজ্ঞেস করলাম।
ওই বাড়িতে নেই, জবাবটা দিলেন সিডার আঙ্কেল।
ড্রাইভওয়ের শেষ মাথায় এসে গাড়ি থামালেন তিনি। নামলাম আমরা। মাথার ওপর দুই হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলাম আমি। দেহের সমস্ত পেশি ব্যথা করছে। ছয় ঘণ্টারও বেশি বাস আর গাড়িতে কেটেছে আমার। এ ভ্যানের পিছন থেকে আমার সুটকেসটা বের করে আনলেন সিডার আঙ্কেল।
বাঁয়ের বাড়িটার দিকে তাকালাম। ভাঙাচোরা, পোড়ো বাড়ির মত লাগছে। অন্ধকার। জানালার কিছু খড়খড়ি খসে পড়েছে। সামনের বারান্দার খানিকটা দেবে গেছে।
ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে কয়েক পা এগোলাম ভাঙা বাড়িটার দিকে। আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কে থাকে, আন্টি
ওটার ধারেকাছে যাবে না। চেঁচিয়ে উঠলেন সিডার আঙ্কেল।
ওখানে কারা থাকে এ নিয়েও কোন প্রশ্ন করবে না! ওই বাড়ির কাছ থেকে দূরে থাকবে, ব্যস!,
রহস্যের গন্ধ পেলাম। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমি, ওই বাড়ির কাছে যেতেই হবে আমাকে। কেন কাছে যেতে নিষেধ করা হয়েছে, জানতে হবে। কিশোর হলেও এই কাজটাই করত।
তিন
শান্ত হও, জন, জুলি আন্টি বললেন। তুমি নিষেধ করেছ, রবিন আর ওখানে যাবে না। আমার দিকে ঘুরলেন তিনি। ফিসফিস করে বললেন, ওই বাড়িতে উলফরা থাকে। আর কোনও প্রশ্ন নয়, ঠিক আছে?
ওই বাড়ি থেকে দূরে থাকবে, চাপা গর্জন করে উঠলেন সিডার আঙ্কেল। এসো, গাড়ি থেকে মালপত্র নামাই।
আবার তাকালাম ভাঙা বাড়িটার দিকে। তারপর আঙ্কেলকে সাহায্য করতে এগোলাম।
মালপত্র নামাতে বেশিক্ষণ লাগল না। আমাকে গেস্টরুমে নিয়ে এলেন জুলি আন্টি। আমার জিনিসপত্র গোছগাছ করে দিতে লাগলেন। সিডার আঙ্কেল গেলেন রান্নাঘরে, মুরগীর মাংস দিয়ে স্যাণ্ডউইচ বানাতে।
আমার ঘরটা খুবই ছোট। দেয়াল আলমারিটা খুদে। পোকামারা ওষুধের গন্ধ বেরোচ্ছে ওটা থেকে। জুলি আন্টি বললেন, কিছুক্ষণ জানালা-দরজা খোলা রাখলেই এ গন্ধ চলে যাবে।
জানালাটা খুলে দিলাম। উলফদের বাড়ির দিকে মুখ করে আছে জানালাটা। মরচে পড়া এক চাকার একটা লোহার ঠেলাগাড়ি বাড়ির একপাশ ঘেঁষে পড়ে রয়েছে। জানালাগুলো অন্ধকার। পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জানালাটার দিকে তাকিয়ে আছি। ভাবছি, উলফদের নিয়ে এত উদ্বেগ কেন সিডার আঙ্কেলের?
জুলি আন্টির কাছে ফিরে এলাম। ড্রেসারের সবচেয়ে ওপরের ড্রয়ারটাতে আমার শার্টগুলো রাখছেন তিনি। ঘরটা খুবই ছোট। তবে থেকে আরাম পাবে। ডেস্কের ওপরটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি। ওটাতে বসে লেখাপড়া করতে পারবে। ১
লেখাপড়া? বিড়বিড় করলাম। মনে পড়ল, বাবা বলে দিয়েছেন, উলফ লেকে যতদিন থাকব, এখানকার স্কুলে যেতে হবে আমাকে। পড়া বাদ দিলে চলবে না।
সোমবার সকালে নিনা তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে, জুলি আন্টি। বললেন। সে-ও তোমার মতই সিক্সথ গ্রেডে পড়ে। দর
অচেনা জায়গায় আজব পরিবেশে একটা নতুন স্কুলে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাল লাগল না আমার। ক্যামেরাটা তুলে নিলাম। বনে যাচ্ছি। ছবি তুলব।
লাঞ্চটা সেরেই যাও, আন্টি বললেন। লম্বা ধূসর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে, ছোট্ট হল পেরিয়ে পথ দেখিয়ে আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে এলেন তিনি।
কাজ করতে করতে ফিরে তাকালেন সিডার আঙ্কেল। তিনটে গ্লাসে কমলার রস ঢাললেন। গোল একটা ডাইনিং টেবিলে রেখেছেন স্যাণ্ডউইচগুলো।