ওদের রুদ্ধশ্বাস চিৎকার কানে বাজছে আমাদের। কথাগুলো কেমন ভূতুড়ে শোনাচ্ছে, প্রতিধ্বনি তুলছে : আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও! আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও!
ঝোপ থেকে বেরিয়ে আবার ছুটলাম। অন্ধকার ছায়ার মত বাড়িগুলোর পাশ কাটাচ্ছি দ্রুত। ভারি নেকড়ের চামড়া পরা অবস্থায় ছুটতে কষ্টটা বেশি হচ্ছে। ঘেমে গোসল করে ফেলছি। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে হৃৎপিণ্ডটা। মনে হচ্ছে আছাড় খেয়ে পড়ে যাব।
আরেকটা মোড় ঘুরলাম। আরেকটা বাড়ির পিছনের আঙিনা পেরোলাম। আমাদের সামনে দেখলাম বড় বড় গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
বনের কাছে পৌঁছে গেছি আমরা। একছুটে বনে ঢুকে পড়লাম দুজনে। লম্বা ঘাস মাড়িয়ে গাছপালার ফাঁক দিয়ে ছুটলাম। আঙ্কেল আণ্টি পিছু ছাড়েননি। আমাদের পিছনে লেগে রয়েছেন। একই কথা বলে চলেছেন বার বার : আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও! আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও!
সবুজ গাছপালায় ছাওয়া একটা নিচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে চললাম আমরা। আমার নেকড়ে-পায়ে বাড়ি লেগে গড়িয়ে পড়তে লাগল আলগা পাথর। ধুড়স করে আছাড় খেল নিনা। চার হাতপায়ে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।
আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও!. আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও! আঙ্কেল-আন্টির তীক্ষ্ণ একঘেয়ে চিৎকার যেন মাথার ভিতরে ঝাঁকি দিতে শুরু করেছে আমার।
মাথা ঘুরছে আমার।
হাঁপাতে হাঁপাতে ওঁদের দিকে ফিরে তাকালাম আমি ও নিনা।
চাঁদটা… ফিসফিস করে আমাকে বলে চাঁদের দিকে হাত তুলল নিনা। পূর্ণ চাঁদ, রবিন। দেখো, একেবারে মাঝআকাশে।
নিনা যখন ফিসফিস করে কথা বলছে, আঙ্কেল-আন্টি তখন হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। মাথা পিছনে হেলিয়ে চাঁদের দিকে মুখ তুলে দিয়েছে। উজ্জ্বল জ্যোত্সায় ওদের মুখে আতঙ্ক দেখতে পাচ্ছি। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ভুগছেন যেন।
হাঁ হয়ে গেল মুখ। তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। বিলাপের মত শোনাল সেই চিৎকার।
দুই হাতে মাথা খামচাতে শুরু করলেন ওঁরা। চুল ছিঁড়তে লাগলেন। ব্যথা সইতে না পেরে চোখ বুজে আর্তনাদ করতে থাকলেন। বুকের গভীর থেকে ভিতরের সবকিছু উলটপালট করে যেন বেরোচ্ছে সেই যন্ত্রণাকাতর চিৎকার।
নিনা, এ-কী করলাম আমরা! প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড় হলো আমার।
ঊনত্রিশ
চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে চিৎকার করেই চলেছেন আঙ্কেল-আন্টি।
থেমে গেলেন একটা সময়।
হাত সরিয়ে আনলেন মাথা থেকে। চিৎকার বন্ধ করলেন। ভঙ্গি দেখে মনে হলো শান্তির পরশ ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীর জুড়ে।
তাকিয়ে আছি ওঁদের দিকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন দুজনে। একে অন্যকে উঠতে সাহায্য করলেন। কাপড় ঝেড়ে দিলেন। চিরুনির মত আঙুল চালালেন চুলে।
অবশেষে যখন মুখ তুলে তাকালেন আমাদের দিকে, দেখলাম, গাল বেয়ে পানি পড়ছে দুজনেরই। কাঁদছেন।
থ্যাংক ইউ, আন্টি বললেন।
আমাদেরকে বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ! ককিয়ে উঠলেন সিডার আঙ্কেল।
তারপর দৌড়ে এলেন দুজনেই। আমাদের জড়িয়ে ধরলেন।
ভয়ঙ্কর অভিশাপ থেকে মুক্তি দিলে আমাদের! জুলি আন্টি বললেন। গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে এখনও। মাঝ আকাশ পেরিয়ে গেছে চাঁদ। এখনও যেহেতু রূপান্তরিত হইনি, আর হব না-আমাদের অভিশাপ কাটল। এখন আর আমরা মায়ানেকড়ে নই!
কী বলে যে ধন্যবাদ দেব তোমাদের! সিডার আঙ্কেল বললেন। তোমাদের সাহস আর বুদ্ধিমত্তার জন্যেই বাঁচলাম আমরা।
এত প্রশংসায় বিব্রত বোধ করছি। প্রসঙ্গ এড়াতে জিজ্ঞেস করলাম, আঙ্কেল, উলফদের কী হয়েছে, জানেন?
হাসলেন আঙ্কেল। তোমরা নিশ্চয় ভাবছ, ওদের খেয়ে ফেলেছি। না, খাইনি। রহস্যময়ভাবে একদিন উধাও হয়ে গেল ওরা। কয়েক দিন বাড়ি থেকে বেরোতে না দেখে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। দেখি, বাড়ি খালি। তখনই পেয়েছি নেকড়ের চামড়া দুটো। আমাদের অভিশপ্ত জীবনের শুরুও সেদিন থেকেই।
কোথায় গেছে ওরা?
জানি না। সেটা এখনও রহস্য।
তারমানে আরেকটা রহস্যের সমাধান করতে হবে এখন আমাদের, ভালই, ভাবলাম। বললাম, উহ্, ভয়ানক গরম! জঘন্য জিনিস, খোলা দরকার! গায়ের নেকড়ের চামড়ায় চাপড় দিলাম। ভীষণ চুলকাচ্ছে!
হ্যাঁ, খুলে ফেলো, আঙ্কেল বললেন। আর ওগুলো গায়ে রাখার দরকার নেই।
চল, বাড়ি যাই, জুলি আন্টি বললেন। সত্যিকারের একটা উৎসব করব আজ। আনন্দ করব। অনেক দিন পর মনটা আজ খুব হালকা লাগছে।
বাড়ি ফিরে চললাম। সারাটা পথই প্রায় হাসাহাসি করতে করতে এলাম।
রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম আমরা।
জুলি আন্টি বললেন, ঘরে বানানো ডোনাট, আর মগভর্তি গরম গরম চকলেট। কেমন মনে হচ্ছে?
দারুণ! দারুণ! একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি ও নিনা।