ঠিক আছে, করব, আবার যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছি আমি।
আর খেয়াল রেখো, উলফদের উঠানে যেন কাটা ঘাস না পড়ে, সাবধান করে দিলেন তিনি। আমি শিওর, তোমার ওপর নজর রাখবেন তাঁরা। কিছু করতে দেখলেই আমাদের কাছে নালিশ করবেন।
ঠিক আছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, কেন শুধু শুধু মিথ্যে বলছেন! উলফ বলে তো কেউ আর এখন নেই! নিশ্চয় আপনারাই খুন করে খেয়ে ফেলেছেন!
আমিও তোমার সঙ্গে কাজ করব, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি। দুজনে মিলে এই আগাছাগুলোকে এমন একটা শিক্ষা দেব যাতে কোনদিন আর বাড়ার সাহস না দেখায়। আজকে এই প্রথম হাসতে দেখলাম ওঁকে।
তাঁর সহজ আণ অবাক করল আমাকে। দ্বিধায় ফেলে দিল। কিন্তু নিজের চোখে নেকড়ের খোলস বদলে মানুষে রূপান্তরিত হতে দেখেছি। এটা কি চোখের ভুল ছিল?
.
সারাদিন আঙ্কেলের সঙ্গে আঙিনায় কাজ করলাম আমি। যখনই আমি একটুক্ষণের জন্য থেমে বিশ্রাম নিতে যাই, শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি।
প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। যন্ত্র ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালাতে চাইছি।
কিন্তু নিনাদেরকে সাবধান না করে যেতেও পারছি না। কী রকম বিপদের মধ্যে রয়েছেন, সেটা ওঁদেরকে জানানো দরকার। নিনাকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।
ডিনারের আগে নিনার সঙ্গে দেখা হলো না। আমাদের খাওয়া প্রায় শেষ, এই সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল ও।
কেমন? কী রকম লাগছে আমাকে? বাতিল পুতুলের পোশাক পরা নিনা নাচার ভঙ্গিতে চক্কর দিয়ে ঘুরে দেখাল।
খুব সুন্দর। জুলি আন্টি বললেন।
আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করল নিনা। রবিন, এখনও তো রেডি হওনি। উৎসব দেখতে যাবে না?
হ্যাঁ, যাব, আমি বললাম। একটু দাঁড়াও, কাপড় বদলে আসি। বেশিক্ষণ লাগবে না। তুমি বরং এসো, আমাকে সাহায্য করবে।
প্রায় টানতে টানতেই নিনাকে আমার ঘরের দিকে নিয়ে চললাম।
বাইরে চমৎকার জ্যোত্স, এত সুন্দর চাঁদ উঠেছে, নিনা বলল। দারুণ জমবে আজ হ্যালোউইন উৎসব।
ঘরে টেনে ঢোকালাম ওকে। দরজা লাগিয়ে দিলাম। শোনো, একটা ভয়ানক খবর আছে।
কপালের ওপর এসে পড়া টুপিটা ওপরে ঠেলে দিল ও। ভয়ানক খবর?
হ্যাঁ। সিডার আঙ্কেল আর জুলি আন্টি দুজনেই মায়ানেকড়ে।
কী বললে! চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার জোগাড় হলো নিনার।
সব কথা খুলে বললাম ওকে। গত রাতে যা যা দেখেছি, সব। ফিসফিস করে কথা বলছি। জানালাম, ওঁদের নেকড়ের চামড়া উলফদের বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন।
কিন্তু উলফরা… বলতে গেল নিনা।
উলফরা নেই, আস্তে কথা বলার কথা ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। বাড়িটা শূন্য। ওখানে নিয়ে গিয়ে চামড়া লুকান আঙ্কেল ও আন্টি। ওঁদের মেরে খেয়ে ফেলেছেন কিনা কে জানে!
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল নিনা। এখন…এখন কী করব আমরা? সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টি দুজনেই এত ভাল মানুষ…
যখন মানুষ থাকেন তখন ভাল, বাধা দিয়ে বললাম। মায়ানেকড়ে হয়ে গেলে পিশাচ হয়ে যান! তোমার আব্বা-আম্মাকে জানানো দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে আমাদের। সাহায্য আনতে হবে। পুলিশকে জানাতে হবে।
কিন্তু…কিন্তু… কথা বলতে পারছে না নিনা। চোখে-মুখে। আতঙ্ক।
হঠাৎ করেই বুদ্ধিটা মাথায় এল আমার। বললাম, নিনা, মায়ানেকড়েরা খোলস বদল করে। মিস্টার রোভার বলেছিলেন, যদি সেই চামড়া পুড়িয়ে ফেলে, আর তখন মায়ানেকড়ে হতে পারে না, ভয়ঙ্কর এক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।
মাথা ঝাঁকাল নিনা। হ্যাঁ। তা বলেছেন। কিন্তু…
আর কোন কিন্তু নেই, উত্তেজিত কণ্ঠে বললাম।
ওই চামড়া পুড়িয়ে ফেলব আমরা, যেভাবেই হোক।
সাতাশ
লিভিং রুমে রয়েছেন আঙ্কেল-আন্টি। ওঁদের নড়াচড়ার শব্দ পাচ্ছি। আমার ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম। মস্ত একটা গোল সাদা চাঁদ উঁকি দিয়েছে গাছপালার আড়ালে। তার ওপরে কয়েক গাছি কালো মেঘ যেন সাপের মত শরীর মোচড়াচ্ছে।
টেনে আমাকে জানালার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে এল নিনা। ফিসফিস করে বলল, চামড়াগুলো লুকিয়ে ফেলতে পারি আমরা!
লুকিয়ে ফেলব? আমিও ফিসফিস করেই জবাব দিলাম। কী হবে তাতে?
স তা হলে আর ওগুলো খুঁজে পাবেন না তোমার আঙ্কেল-আন্টি, নিনা জবাব দিল। ভালয় ভালয় রাতটা পার করে দিতে পারলেই হয়। নেকড়েতে রূপান্তরিত হতে পারবেন না আর তাঁরা।
ঠিক বলেছ! একটা রাত নেকড়ে না হয়ে পার করে দিতে পারলে হয়তো ভাল হয়ে যাবেন তারা, আর মায়ানেকড়ে হবেন না।
মাথা ঝাঁকাল নিনা। চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কাজ হতেও পারে… হঠাৎ থেমে গেল ও। না, না, দাঁড়াও! আরও ভাল বুদ্ধি এসেছে মাথায়! আমরা নিজেরাই চামড়াগুলো পরে ফেলতে পারি!
কী বললে? নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেল আমার। পরে ফেলব? কেন?
কারণ চামড়া লুকিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারব না। তোমার আঙ্কেল আন্টি কোথাও খুঁজতে বাকি রাখবেন না। বাড়ির ভিতরে, গ্যারেজে, উঠানের ঝোপঝাড়ে, সবখানে খুঁজবেন। কিন্তু আমাদের গায়ে খোঁজার কথা ভাববেন না। কল্পনাই করবেন না আমরা ওগুলো পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
কিন্তু চামড়া পরে আমরাও যদি মায়ানেকড়ে হয়ে যাই?
হব না, মাথা নাড়ল নিনা। মিস্টার রোভার কি বলেছেন ভুলে গেছ? বলেছেন, চামড়া পরে পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনবার নেকড়ের মত চিৎকার করতে হবে, তা হলেই মায়ানেকড়ে হওয়া যাবে। আমরা চিৎকার করব না।