নিনা আর ওর বাবা-মাকে সাবধান করে দিতে হবে। তারপর পালাতে হবে এই এলাকা থেকে, যতদূরে পারি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত ফিরে চললাম। শোবার ঘরে এসে জানালার
চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে লাফিয়ে নামলাম।
গাছের মাথায় এখনও মস্ত একটা লাল বল হয়ে আছে সূর্যটা। ঘাসের ডগায় ঝিলমিল করছে ভোরের শিশির।
নিনা নিশ্চয় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে এতক্ষণে, ভাবলাম। আর যদি না জেগে থাকে তো আমাকেই ওর ঘুম ভাঙাতে হবে।
উলফদের জানালার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়ালাম। ছুটতে শুরু করলাম নিনাদের বাড়ির দিকে।
বড়জোর ছয়-সাত কদম এগিয়েছি। থমকে দাঁড়ালাম জুলি আন্টির।
চিৎকারে, রবিন, কোথায় যাচ্ছ তুমি!
পঁচিশ
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম প্রায়। টলে উঠে কোনমতে সামলে নিলাম।
রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন জুলি আন্টি। জিজ্ঞেস করলেন, রবিন, এত সকালে উঠলে যে? আজ তো শনিবার। চোখের পাতা সরু করে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি।
আমি…ইয়ে… এমন কাঁপুনি উঠে গেছে শরীরে, কথা বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে।
এত তাড়াহুড়া করে কোথায় যাচ্ছ? আণ্টি জিজ্ঞেস করলেন। তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম সিডার আঙ্কেলকে।
ওই তো…নিনাদের বাড়িতে… কোনমতে জবাব দিলাম। ওর সঙ্গে কথা আছে…আজ রাতে কী পোশাক পরব, সেটা নিয়ে আলোচনা করব।
আণ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার কথা কি বিশ্বাস করেছেন? তাই তাকে
মনে হয় না।
এত ভোরে নিনাদের বাড়ি যাচ্ছ? শপাং করে উঠল তার কণ্ঠ। হাত নেড়ে ডাকলেন, এসো। আগে নাস্তা খেয়ে যাও।
দ্বিধা করছি। ভাবনাগুলো বনবন করে ঘুরছে যেন মাথার ভিতর।
দৌড় দেব নাকি? দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে ছুটতে থাকব?
কিন্তু কতদূর যেতে পারব? ওঁরা আমাকে ধরে ফেলবেন।
আমার আঙ্কেল-আন্টি, দুজনেই মায়ানেকড়ে। ধরতে পারলে কী করবেন? আমাকে দিয়ে নাস্তা করে ফেলবেন?
না। দৌড়ানোটা ঠিক হবে না। এখনও সময় হয়নি। পালানোর আগে নিনাকে সাবধান করে দিতে হবে। ওকেও সঙ্গে নিতে হবে।
গুটি গুটি পায়ে এগোলাম। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আন্টি। ঘরে ঢুকতেই মৃদুকণ্ঠে আমাকে গুড মর্নিং জানালেন সিডার আঙ্কেল। বললেন, বেশি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়েছ।
মাথা ঝাঁকিয়ে নাস্তা খেতে টেবিলে বসলাম।
সারারাত কাজ করেছি আমি আর কেরি, বড় করে হাই তুললেন সিডার আঙ্কেল। চমঙ্কার কিছু ছবি তুলেছি।
মিথ্যে কথা! চিৎকার করে বলতে চাইলাম। আমি আপনাদের অনুসরণ করেছি। আপনারা কী করেছেন দেখেছি। আপনারা কী জিনিস, জানি আমি। আমার সামনে উলফদের কাছে আন্টির ফোন করাটা পুরোই ফাঁকিবাজি। আমাকে দেখানোর জন্যে। উলফরা আমার নামে পুলিশের কাছে নালিশ করেছে, এটাও আপনাদের বানানো কথা!
কিন্তু কিছু বললাম না। তাকিয়ে আছি কর্নফ্লেকের বাটির দিকে।
দুটো মায়ানেকড়ের সঙ্গে নাস্তা, খেতে বসেছি–ভাবনাটা পেটের ভিতর মোচড় দিতে থাকল আমার। সারাটা রাত বনের ভিতর ঘুরে বেড়িয়েছেন আমার আঙ্কেল-আন্টি, অসহায় জানোয়ারগুলোকে ধরে ধরে নিষ্ঠুরভাবে খুন করেছেন।
একটা মুহূর্তও আর বসে থাকতে পারব না, ভাবলাম। উঠে। দাঁড়াতে গেলাম।
আমার কাঁধে হাত রাখলেন সিডার আঙ্কেল। শান্ত হও, রবিন। বসো। নাস্তা খাও, মোলায়েম স্বরে বললেন তিনি।
কিন্তু, আমি… কী বলব বুঝতে পারছি না। এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি, খেতে ইচ্ছে করছে না। আমার কাঁধ থেকে তার হাতটা সরিয়ে দিতে পারলে ভাল হত। আমার গা কাঁপছে।
খাও। না খেলে শরীর ঠিক থাকবে না, আঙ্কেল বললেন। হ্যালোউইন উৎসব দেখতে বেরোবে না? অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে হবে।
নাস্তা খাও, নাস্তা খাও, জুলি আন্টি বললেন। কাজে লাগবে।
আমার কর্নফ্লেক খাওয়া দেখতে লাগলেন ওঁরা। শীতল দৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে। জোর করে গলা দিয়ে নামাচ্ছি।
ওঁদেরকে অনুসরণ করেছিলাম, ওদের গোপন কথা জেনে গেছি, নিশ্চয় বুঝে ফেলেছেন।
তাই আমাকে যেতে দিতে চান না।
আমাকে নিনাদের ওখানে যেতে হবে, শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম আমার কণ্ঠস্বর। চেয়ার পিছনে সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলাম।
কিন্তু আবার আমার কাঁধ চেপে ধরলেন সিডার আঙ্কেল। আঙুলগুলো চেপে বসল কাঁধে।
এসো আমার সঙ্গে, আদেশের সুরে বললেন তিনি।
ছাব্বিশ
আমার কাঁধে শক্ত হয়ে চেপে থাকল আঙ্কেলের হাত। আমাকে ঠেলে নিয়ে চললেন গ্যারেজের দিকে। দ্রুত হাঁটছেন। একটা কথাও বলছেন না।
একবার ভাবলাম, ঝাড়া দিয়ে কাঁধ থেকে তাঁর হাত ছুটিয়ে দৌড় দিই।
কিন্তু কতদূর যেতে পারব?
আমার কাঁধ ছেড়ে দিলেন তিনি। কী করবেন আমাকে?
আপনাদের পিছু নেয়াটা ঠিক হয়নি আমার, ফিসফিস করে বললাম, গলা দিয়ে কথা বেরোতে চাইছে না। আমি…আমি কাউকে বলব না, যা দেখেছি।
আমার কথা যেন কানেই ঢুকল না তাঁর। গ্যারেজের কোনায় এসে লম্বা হাতলওয়ালা একটা জিনিস তুলে নিলেন।
আমার দিকে ওটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে। প্রচুর কাজ। একা পারব না।
কাজ? ঢোক গিলোম।
মাথা ঝাঁকালেন সিডার আঙ্কেল। এটা দিয়ে ঘাস কাটা হয়। এ জিনিস আর দেখেছ কখনও?
না। যন্ত্রের হাতল ধরা হাতটা কেঁপে উঠল আমার। ব্যবহার করা খুব সহজ, তিনি বললেন। গ্যারেজের পিছনের এই ঘাসগুলো কেটে সাফ করতে হবে তোমাকে।