গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখছি। কাছে যেতে ভয় পাচ্ছি। ক্রমেই ওপরে উঠছে সূর্যটা, আলো বাড়ছে। এখন যদি ঘুরে দাঁড়ায় নেকড়ে দুটো, আমাকে দেখে ফেলবে।
ক্যামেরা উঁচু করলাম। আর মাত্র কয়েকটা শট বাকি।
সামনের দুই পা উঁচু করে দেয়ালে রেখে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল ওরা।
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। চামড়ার আলখেল্লা খুলছে ওরা।
রোমশ চামড়া যেন সাপের খোলসের মত খুলে যাচ্ছে গা থেকে। এই অবস্থায় একটা ছবি তুললাম।
থাবা থেকে চামড়া সরে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেল নখ। ছবি তুললাম এটারও। চামড়া উল্টে সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল মানুষের হাত-পা। তারপর শরীর থেকেও চামড়া সরে গেল।
আমার দিকে পিছন ফিরে আছে ওরা। চামড়ার আলখেল্লা খুলে ফেলল। উলফদের চেহারা কেমন দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি। গা থেকে আলখেল্লা খুলে মাটিতে রাখল ওরা। তারপর ঘুরে দাঁড়াল।
ওদের মুখ দেখে চমকে উঠলাম। তবে ক্যামেরার শাটার টিপতে ভুললাম না।
চব্বিশ
সকালের রোদ পড়েছে ওঁদের মুখে।
অনেক কষ্টে চিৎকার ঠেকালাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে আছি।
উলফরা নয়, আমার আঙ্কেল-আন্টিই মায়ানেকড়ে!
আড়মোড়া ভাঙলেন সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টি। আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করলেন। হাত দিয়ে টেনেটুনে গায়ের কাপড় ঠিক করলেন। নিচু হয়ে তুলে নিলেন নেকড়ের চামড়া দুটো।
বনের দিকে তাকালেন আঙ্কেল। ঝট করে সরে গেলাম একটা গাছের আড়ালে।
আমাকে কি দেখে ফেললেন?
থরথর করে কাঁপছি। চেঁচিয়ে উঠতে চাইলাম : না না, আমি বিশ্বাস করি না! এ হতে পারে না!
গাছের গায়ে নিজেকে ঠেসে রেখে নিজের মুখ চেপে ধরে রাখলাম। কোনমতেই বেরোতে দিলাম না চিৎকারটা।
ভাবতে হবে আমাকে। এখন কী করব?
ওদের সঙ্গে আর আমার থাকা চলবে না, বুঝে গেছি। দুটো মায়ানেকড়ের সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করা অসম্ভব।
কিন্তু কোথায় যাব? কে আমাকে সাহায্য করবে? আমার কথা কে বিশ্বাস করবে?
নেকড়ের চামড়া দুটো ভাঁজ করছেন আঙ্কেল-আন্টি। তারপর জুলি আন্টিকে বেডরুমের জানালায় উঠতে সাহায্য করলেন সিডার আঙ্কেল। আন্টি ভিতরে যেতেই তিনিও লাফিয়ে উঠে ভিতরে ঢুকে গেলেন।
উলফদের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা হলো। ওঁরা কোথায়? আঙ্কেল-আন্টি যে ওদের বাড়িতে ঢুকছেন, কিছু বলছেন না কেন? কেন বাধা দিচ্ছেন না? নাকি ওদের খুন করে ফেলেছেন আমার আঙ্কেল-আন্টি।
ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার কথাটা মাথায় ঢুকতে শিউরে উঠলাম।
কয়েক মিনিট পর সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টি বেরিয়ে এলেন জানালা দিয়ে। তাড়াহুড়া করে ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
গাছে ঠেস দিয়ে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। উলফদের বাড়ির দিকে চোখ। মনে ভাবনার ঝড়।
দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে। রাস্তায় বেরিয়ে ছুটে সরে যেতে চাইছি আঙ্কেলের বাড়ি থেকে দুরে, বহুদুরে।
কিন্তু প্রচণ্ড কৌতূহল আমাকে ছুটতে দিল না। উলফদের কী হয়েছে দেখতেই হবে। সত্যিটা না জেনে কিছুতেই যেতে পারব না। আমি এখান থেকে। তা ছাড়া নিনা রয়েছে। ওকেও নিয়ে যেতে হবে। এই বিপদের মধ্যে ওকে রেখে যাওয়া চলবে না।
আরও কিছুক্ষণ বাড়ি দুটোর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করলাম। কারও ছায়াও দেখলাম না, কোথাও কোন নড়াচড়া নেই। নিজের
গাছের কাছ থেকে সরে এলাম। একছুটে ঢুকে পড়লাম উলফদের বাড়ির পিছনের ঘাসে ঢাকা আঙিনায়। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে আমার আঙ্কেল-আন্টির বাড়িটার দিকে তাকালাম। ওঁদের বেডরুমের জানালা বন্ধ। খড়খড়ি নামানো।
আবার সোজা হয়ে, দম আটকে দৌড় দিলাম। চলে এলাম উলফদের বেডরুমের জানালার নীচে। জানালার চৌকাঠ ধরে ভিতরে উঁকি দিলাম। অন্ধকার। কিছুই চোখে পড়ছে না।
বিড়বিড় করে নিজেকে বললাম, ঢুকে পড়ো! দেরি করে লাভ নেই! না জানালার চৌকাঠ ধরে নিজেকে টেনে তুললাম ওপরে। চৌকাঠে বসে পা ঘুরিয়ে দিয়ে লাফিয়ে পড়লাম ঘরের ভিতরে। আবছা অন্ধকার চোখে সয়ে আসতে কয়েক সেকেণ্ড লাগল। চায়
কিছুই নেই ঘরে। এক র একটা আসবাব নেই। দেয়ালে নেই ছবি কিংবা আয়না। কাঠের মেঝেতে কার্পেট নেই। পুরু হয়ে জমে আছে ধুলো।
শোবার ঘরের সামনের দরজার দিকে তাকাতে চোখে পড়ল নেকড়ের চামড়া দুটো। সুন্দর করে ভাঁজ করে দরজার পাশে রেখে দেয়া হয়েছে।
ভারি দম নিয়ে সাবধানে এগোলাম খোলা দরজাটার দিকে। ওপাশের হলওয়েতে উঁকি দিলাম। শোবার ঘরের মতই এটাও আসবাবশূন্য।
কেউ আছেন? ডাক দিলাম। এই, কেউ আছেন?
জবাব নেই।
পা টিপে টিপে এগিয়ে চললাম হলওয়ে ধরে বাড়ির সামনের দিকে। যে কটা দরজা পড়ল, সবগুলোর ভিতরে উঁকি দিলাম।
প্রতিটি ঘরই খালি। মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ।
লিভিং রুমের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম। কোনও আসবাব নেই। বাতি নেই।
কেউ থাকে না এখানে! জোরে জোরে বলে ফেললাম। আমার কথা প্রতিধ্বনিত হলো চারপাশের দেয়ালে।
উলফরা কোথায়?
ওদের খুন করে খেয়ে ফেলেছেন আমার আঙ্কেল-আন্টি-ভয়ঙ্কর এই ভাবনাটা আরও বদ্ধমূল হতে থাকল মনে। খরগোশ মেরে ছিন্নভিন্ন করে ওটাকে গোগ্রাসে গেলার দৃশ্যটা কল্পনা করলাম। ক্যামেরায় তোলা আছে সেই ছবি। হরিণ ছানাটাকে আক্রমণের কথাটাও ভাবলাম।
নিনাকে সাবধান করে দিতে হবে। কেউ নিরাপদ নয় এখানে।