.
শিকার নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে ওরা।
যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর চিত হয়ে থাকা একটা প্রাণীর চারটে খুর ওপর দিকে উঠে যেতে দেখলাম।
না, মানুষকে আক্রমণ করেনি। একটা হরিণ ধরেছে। হরিণের বাচ্চা।
খুন করে ফেলবে ওটাকে।
ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে।
কী করব? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। কীভাবে বাঁচাব ওটাকে?
ভাবতে পারছি না। কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। তবুও বিনা চেষ্টায় ছেড়ে দিতে রাজি নই। মাথাটা পিছনে হেলিয়ে নেকড়ের মত চিৎকার করে উঠলাম।
গাছে গাছে প্রতিধ্বনি তুলল আমার চিৎকার।
থমকে গেল মায়ানেকড়ে দুটো। মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল।
খুব সামান্যই সুযোগ পেল বাচ্চাটা। তবে সেটার সদ্ব্যবহার করতে দেরি করল না। মায়ানেকড়ের থাবার নীচ থেকে বেরিয়ে ছুটে পালাল। হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।
ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল মায়ানেকড়ে দুটো। বাতাস শুঁকতে লাগল। চাঁদের আলোয় ওদের লাল চোখ ঝকঝক করে জ্বলছে। চাপাস্বরে গর্জন শুরু করল।
মাথা নিচু করে ছুটে আসছে আক্রমণের ভঙ্গিতে। নিশ্চয় আমিই এখন ওদের লক্ষ্য।
তেইশ
নড়তেও ভয় পাচ্ছি।
তবু টলতে টলতে পিছিয়ে গেলাম দুই কদম। দৌড়ানোর সময় নেই। মনে হলো মায়ানেকড়ের পায়ের দাপটে মাটি কাঁপছে। চিৎকার করতে মুখ খুললাম। স্বর বেরোল না।
পিশাচ দুটোর দাঁতে দাঁত ঘষার কুৎসিত শব্দ হচ্ছে। চোখ যেন জ্বলন্ত কয়লার টুকরো।
আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে সামনের দিকে হাত দুটো বাড়িয়ে ধরলাম।
কিন্তু আমাকে আক্রমণ করল না নেকড়ে দুটো।
আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ডানে মোড় নিল তীব্র গতিতে। পাশাপাশি দৌড়াচ্ছে দুটোতে। ভয়ঙ্কর গর্জন করছে।
বাদামী রঙের একটা বড় খরগোশ এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার ওপর।
ওটার দিকেই লক্ষ্য ওগুলোর। সহজেই ধরে ফেলল খরগোশটাকে। কিছুই করতে পারল না ছোট্ট জানোয়ারটা।
একটা নেকড়ে এক কামড়ে ওটার ঘাড় ভেঙে দিল। অন্য নেকড়েটা পেটে কামড় বসাল।
দ্রুত হাতে কেস থেকে বের করে আনলাম ক্যামেরাটা।
ভিউ ফাইণ্ডার চোখের সামনে তুলে আনার সময় লক্ষ করলাম প্রচণ্ড হাত কাঁপছে। দুই হাতে ধরে স্থির করলাম ক্যামেরাটা।
শাটার টিপে দিলাম।
খরগোশটাকে টেনে ছেঁড়ার সময় ছবি তুললাম একটা। আরেকটা তুললাম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খাওয়ার সময়।
খরগোশটার কিছুই অবশিষ্ট রাখল না ওরা। খাওয়া শেষ হলে ঠোঁট চাটল, তারপর দুলকি চালে অদৃশ্য হয়ে গেল গাছপালার ভিতর।
দুই হাতে ক্যামেরাটা উঁচু করে ধরে ওগুলোর পিছু নিলাম।
মনে হচ্ছে ঘোরের মধ্যে রয়েছি আমি। ভাবনাগুলো পরিষ্কার হচ্ছে।
আরেকটু হলেই গেছিলাম আজ। খরগোশটা না এলে এতক্ষণে আমি মায়ানেকড়ের খাবার হয়ে যেতাম।
ছবি ভোলা হয়ে গেছে। কিন্তু বন থেকে এখনই বেরোতে পারব না।
আমার আঙ্কেল-আন্টিকে সাবধান করে দিতে হবে। ওঁদের খুঁজে বের করে বলতে হবে, উলফদের ব্যাপারে ভুল করেছেন। কী ভয়ানক বিপদের মধ্যে রয়েছেন, জানাতে হবে ওদের।
আতঙ্কে ধড়াস ধড়াস করছে আমার হৃৎপিণ্ডটা। থরথর করে হাত পা কাঁপছে। দুর্বল লাগছে। আমি যেন আমি নই। মনে হচ্ছে আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে তাকিয়ে আছি নিজের দেহটার দিকে।
পিশাচগুলোর কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে অনুসরণ করে চললাম। ফিরে তাকালে চট করে গাছ কিংবা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ব। ক্যামেরাটা উঁচু করে রেখেছি, ছবি তোলার জন্য।
লেকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওগুলো। পানির কিনারে গিয়ে দাঁড়াল। লম্বা জিভ বের করে কুকুরের মত পানি খেতে লাগল।
দেখে এখন বোঝার উপায় নেই ওরা মানুষ। পুরোপুরি নেকড়েতে রূপান্তরিত হয়েছে। জ্বলন্ত চোখগুলো শিকারি জানোয়ারের চোখের মত জ্বলছে।
অনেকক্ষণ ধরে পানি খেয়ে পেট ভরল ওরা। আরও কয়েকটা ছবি তুললাম।
নিনা আমার সঙ্গে না এসে ভুল করেছে। স্বচক্ষে দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। আর
হঠাৎ ঝটকা দিয়ে পানি থেকে মাথা তুলল পিশাচ দুটো। ঘুরে দাঁড়াল। নাক উঁচু করে বাতাস শুঁকতে লাগল।
আমার গন্ধ পেল নাকি ওরা?
মোটা একটা গাছের আড়ালে সরে গেলাম আমি। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সি কিছুক্ষণ পর সাবধানে আবার মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখি লেকের পাড় ধরে চলে যাচ্ছে ওরা। কিছুটা সময় দিয়ে, গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে দূরত্ব রেখে আবার পিছু নিলাম ওগুলোর।
.
সারাটা রাত মায়ানেকড়ে দুটোকে অনুসরণ করলাম আমি। এক রোল। ফিল্ম শেষ করে আরেকটা ঢোকালাম। পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে চাঁদের দিকে মুখ তুলে যখন চিৎকার করছিল ওরা, সেই দৃশ্যের ছবি তুলেছি। ছবি তুলেছি আরও কিছু ভয়ঙ্কর দৃশ্যের। এ ছবি তোলার পাশাপাশি জঙ্গলে খুঁজে বেড়িয়েছি আমার আঙ্কেল আন্টিকে। মরিয়া হয়ে উঠেছি ওদের সাবধান করার জন্য, কী দেখেছি বলার জন্য।
ভীত, উত্তেজিত অবস্থায় পিশাচগুলোর পিছনে চলতে চলতে সময়ের হিসেব রাখিনি। মনে হচ্ছিল অদ্ভুত এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সমস্ত ঘটনা অবাস্তব।
অবশেষে সূর্যের এক চিলতে লাল আলো এসে পড়ল মাটিতে। কখন যে ভোর হয়েছে খেয়ালই করিনি।
ধীরে হাঁটছে এখন মায়ানেকড়ে দুটো। তাড়াহুড়া নেই। খেয়ে খেয়ে পেট ভরিয়েছে। ভারি করে ফেলেছে শরীর।
বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে ওদের বাড়ির পিছনের আঙিনায় চলে গেল। হেঁটে গেল বেডরুমের জানালার নীচে।