দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জুলি আন্টি। সে-কারণেই এতকাল তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। আবার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
আমি আশা করেছিলাম আপনাদের সঙ্গে কোথাও ছবি তুলতে যাব, আমি বললাম। আপনাদের কাছ থেকে ছবি তোলার টেকনিক শিখব।
নিশ্চয় যাবে, হেসে উঠলেন সিডার আঙ্কেল। আমরা যা যা জানি, সবই শেখাব তোমাকে।
বেশ কিছুদিন তো থাকবে, জুলি আন্টি যোগ করলেন। কোনও চিন্তা নেই, ফটোগ্রাফি শেখার প্রচুর সময় পাবে।
তবে এই পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থাকলে প্রচুর সময় আর থাকবে না, কমে যাবে, হেসে বললেন সিডার আঙ্কেল। একটানে আমার সুটকেসটা তুলে নিয়ে ভ্যানের পিছনে ফেললেন তিনি। না গাড়িতে চড়লাম আমরা। কয়েক সেকেণ্ড পরেই বাস স্টেশন ছেড়ে রওনা হলো ভ্যান, শহরের দিকে।
পোস্ট অফিসের পাশ কাটালেন আঙ্কেল। তারপর ছোট একটা মুদি দোকান, আর একটা ধোপর দোকান। একটা রাস্তা পেরিয়ে এসে বনে ঢুকলাম আমরা। ঘন বন চারপাশ থেকে যেন গ্রাস করে নিল আমাদের।
মাত্র এই কটা দোকানপাট? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
রবিন, জুলি আন্টি বললেন, এসেছ তো বন দেখতে, শহর নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন?
হ্যাঁ, শহরটা ছোট না বড়, তাতে কিছু যায় আসে না, সিডার আঙ্কেল বললেন। গাছপালার মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তায় তীক্ষ্ণ। মোড় নিল গাড়ি।
না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম, জবাব দিলাম। আমি আসলে বনের ভিতরই ঘুরে বেড়াতে চাই। বনের ছবি তুলেই একশো রোল ফিল্ম
খরচ করে ফেলব! ঘোষণা করার মত জানিয়ে দিলাম।
প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল গাড়ি। লাফিয়ে উঠল আমার শরীর। আরেকটু হলেই ছাতে বাড়ি খেত মাথা।
আস্তে চালাও, জন। জুলি আন্টি বললেন। আমার দিকে ফিরে বললেন, তোমার আঙ্কেল আস্তে চালাতে জানেই না। এত তাড়াহুড়া করে, যেন রকেট নিয়ে ভিনগ্রহে চলেছে, আলোর গতিতে চলতে হবে।
আলোর কথায় মনে পড়ল, বাইরের আলোতে ছবি তোলার কিছু চমৎকার কায়দা শিখিয়ে দেব তোমাকে, রবিন, সিডার আঙ্কেল বললেন। গতি কমানোর বদলে আরও জোরে গ্যাস পেডাল চেপে ধরলেন তিনি।
আমাদের স্কুলে একটা ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে আমাকে, ওঁদের জানালাম। তার জন্যে ভাল কিছু ছবি দরকার আমার, হ্যালোউইনের ছবি, যাতে প্রতিযোগিতায় জিততে পারি।
ও পেয়ে যাবে। হ্যালোউইনের এখনও দুদিন বাকি।
শুনেছি, হ্যালোউইনের সময় মায়ানেকড়ে বেরোয়। ওগুলোর। একটা ছবি পেলে…
আমার কথা শেষ হলো না। পথের পাশের একটা সাইনবোর্ডে গুঁতো মারল গাড়ি। সিট থেকে প্রায় উড়ে গিয়ে ধাক্কা খেলাম দরজায়। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম অসহায় দৃষ্টিতে। সামনে থেকে গর্জন করে ছুটে আসা একটা ট্রাকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি।
দুই
তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল আমার গলা চিরে।
নিজের চিৎকার বলে মনেই হলো না।
প্রচণ্ড ঝকি খাচ্ছে আমাদের গাড়ি। সিটে বসে থাকতে পারলাম না। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম মেঝেতে।
রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর গাড়ি সরিয়ে নিয়েছেন সিডার আঙ্কেল।
ভারি গর্জন তুলে লাল রঙের একটা ঝিলিমিলির মত আমাদের পাশ কাটাতে দেখলাম ট্রাকটাকে। রেগে গিয়ে হর্ন চেপে ধরে রেখেছে ড্রাইভার।
গাছের নীচে এনে গাড়ি থামালেন সিডার আঙ্কেল। কোঁচকানো মুখটা লাল হয়ে গেছে। দুই হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে মাথা রাখলেন তাতে।
জন, কী হয়েছে? মোলায়েম কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন জুলি আন্টি।
সরি, বিড়বিড় করলেন সিডার আঙ্কেল। ভারি দম নিলেন। ঠিক মনোযোগ দিতে পারছিলাম না।
আরেকটু হলেই তো মেরে ফেলছিলে আমাদের। প্যাসেঞ্জার সিট থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমি কেমন আছি দেখলেন জুলি আন্টি। রবিন, ঠিক আছ তো তুমি?; উচীর জানা নয়
আছি, জবাব দিলাম। এখানে যে এত উত্তেজনা, কল্পনাই করিনি! রসিকতার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে গলা কাঁপছে।
আমার খাপ সহ ক্যামেরাটা মেঝেতে পড়ে গেছে। তুলে নিয়ে খাপের ভিতর থেকে ক্যামেরাটা বের করে দেখলাম। মনে হলো ঠিকই আছে।
ছা আবার ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন সিডার আঙ্কেল। রাস্তায় তুলে আনলেন গাড়িটাকে। আমি সত্যিই দুঃখিত, বিড়বিড় করলেন তিনি। এখন থেকে আরও সাবধানে চালাব।
আবার নিশ্চয় উলফদের কথা ভাবছিলে, তাই না? অভিযোগের সুরে বললেন জুলি আন্টি। রবিনকে মায়ানেকড়ের কথা বলতে শুনে ওদের নিয়ে ভাবতে আরম্ভ করেছ আবার, আর তাতেই…
আহ্, থামো তো, জুলি! ধমকে উঠলেন সিডার আঙ্কেল। ওগুলোর কথা বোলো না এখন। রবিন মাত্র এল। বাড়ি পৌঁছার আগেই ওকে ভয় দেখিয়ে কাবু করে ফেলতে চাও?
কিন্তু ও-ই তো মায়ানেকড়ের কথা তুলল।
উলফরা কারা? সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তাই
থাক, বাদ দাও, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল সিডার আঙ্কেলের কণ্ঠ। বসো আরাম করে।
জুলি আন্টি বললেন, বাড়ির কাছে চলে এসেছি।
মনে হলো দুজনেই আমার প্রশ্নটা এড়াতে চাইছেন। দক
অন্ধকার লাগছে জায়গাটা। সরু রাস্তার দুই পাশে গাছের মাথা এমনভাবে গায়ে গায়ে লেগে গেছে, রোদ ঢুকতে দিচ্ছে না।
পাশ দিয়ে সরসর করে সরে যাচ্ছে গাছগুলো। হলুদ আর লাল পাতার ঝিলিক দেখছি শুধু। গভীর ভাবনা মনে। আমার আঙ্কেল-আন্টিকে কেমন আজব চরিত্র মনে হচ্ছে। উলফদের কথা বলাতে আন্টির ওপর এমন খেপে উঠলেন, কেন আঙ্কেল?
জায়গাটাকে উলফ লেক বলে কেন? জিজ্ঞেস করলাম।