ঘোরো! ঘুরে দাঁড়াও! ঝোপের আড়ালে বসে কাঁপতে কাঁপতে নীরবে বলতে থাকলাম। প্লিজ, ঘুরে দাঁড়াও। আমি তোমাদের মুখ দেখতে চাই।
ওরা চলতে শুরু করতেই অস্পষ্ট একটা গোঙানি বেরিয়ে গেল আমার মুখ থেকে। ভারি আলখেল্লাটা ওদের গায়ে শক্ত হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে জ্যান্ত প্রাণীর মত।
এতক্ষণে বুঝলাম, ওগুলো কাপড়ের আলখেল্লা নয়, জানোয়ারের চামড়া।
নেকড়ের চামড়া না তো?
আবার গোঙানি বেরিয়ে এল আমার মুখ থেকে। এত জোরে কাঁপতে শুরু করলাম, হাত থেকে ছুটে গেল ক্যামেরা কেস। দুই হাঁটু পেঁচিয়ে ধরলাম হাত দিয়ে। আবার চেঁচিয়ে উঠল মূর্তি দুটো। রোমশ দুই হাত মাথার ওপর তুলে ধরেছে। থাবা থেকে বেরিয়ে আসছে ধারাল নখ।
দুই থাবার নখ ঘষে যেন পরখ করে নিল শিকারের ওপর কতটা কার্যকরী হবে ওগুলো। গর্জন করছে, ঘোঁতঘোঁত করছে। চারপায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াল।
এখন আর মানুষ নেই ওরা। জানোয়ার…নেকড়ে…পিশাচ…
নিনা ঠিকই বলেছে। সত্যি কথা বলেছে, উলফরা মায়ানেকড়ে। চাঁদের আলোয় ওরা পিশাচ হয়ে যায়। নেকড়ের রূপধারী পিশাচ।
কাঁপা হাতে আবার তুলে নিলাম ক্যামেরা কেসটা। আবার জিপার খোলার চেষ্টা করলাম। সফল হলাম এবার। অবশেষে খুলতে পারলাম আমারটা।
এই সময় ঘুরে দাঁড়াল ওরা। আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। দুটো নেকড়ে।
লোমে ঢাকা কপালের নীচের অক্ষিকোটর থেকে তাকিয়ে আছে কালো একজোড়া চোখ। লোমে ঢাকা চোয়াল ফাঁক হয়ে বেরিয়ে পড়ল ধারাল দাঁতের সারি।
মায়ানেকড়ে। উলফরা মায়ানেকডে।
পরস্পরের গায়ে নাক ঘষতে লাগল মায়ানেকড়ে দুটো। চাপা গরগর করছে। হাঁটু গেড়ে বসে ক্যামেরা তুললাম।
অন্তত একটা ছবি তুলতেই হবে আমাকে। ভোলো, তোলো, দেরি কোরো না! আদেশ দিলাম নিজেকে।
ভীষণ কাঁপছে আমার হাত। ক্যামেরাটা স্থির রাখতে পারছি না।
তোলো! তোলো!
চোখের সামনে তুলে আনলাম ভিউফাইণ্ডার। আরেকটু উঁচু করলাম মাথা, ঝোপের ওপর দিয়ে ভাল করে দেখার জন্য।
উহ! দেহটা উঁচু করতে যেতেই ভাঙা চোখা ডালের খোঁচা খেলাম গালে।
ক্যামেরাটা ছুটে গেল হাত থেকে।
ঘাসের ওপর পড়ল। ঘুরে তাকাল পিশাচ দুটো। দেখে ফেলল নাকি আমাকে!
বাইশ
মাটিতে পেট ঠেকিয়ে শুয়ে পড়লাম উপুড় হয়ে।
ওঠানামা করছে আমার বুক। মুখ দিয়ে দম নিচ্ছি এখন। দেহটাকে স্থির রাখার, পুরোপুরি নিঃশব্দ থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
ওরা কি আমাকে দেখেছে?
না তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। আবার মাথা উঁচু করলাম। ঝোপের ভিতরের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।
রোমশ নাক উঁচু করে বাতাস শুঁকছে ওরা। আমার গন্ধ পেয়েছে? জেনে গেছে আমি এখানে রয়েছি?
লাফিয়ে ঝোপ ডিঙিয়ে এসে আমার দেহটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে এখন?
আবার বাতাস কল ওরা। চাপাস্বরে ঘোঁতঘোঁত করছে। কিন্তু এল না ওরা। ঘুরে দাঁড়াল। চারপায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটল বনের দিকে। সে ওদের পায়ের শব্দ, চাপা গর্জন আর ঘোঁতঘোঁতানি যখন আর একেবারেই শোনা গেল না, তখন উঠে বসলাম। হাত বাড়িয়ে তুলে নিলাম ক্যামেরাটা।
আমার এত সাধের ক্যামেরা!
কোন ছবিই তুলতে পারিনি। একটা ছবিও না।
কম্পিত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। লেন্স থেকে শিশির মুছলাম। ফিরে তাকালাম বনের দিকে।
ঠিক করলাম, ওদের অনুসরণ করব আমি।
ছবি আমাকে তুলতেই হবে। এ রকম সুযোগ আর জীবনে পাব না।
মায়ানেকড়ের ছবি তুলতে পারলে প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া শুধু নয়, বিখ্যাত হয়ে যাব আমি। পত্রিকার পাতায় আর ম্যাগাজিনের কভারে আমার ছবি ছাপা হবে। আমার ভোলা উলফদের মায়ানেকড়ে হওয়া ছবিগুলো ফ্যান্সি ফটো গ্যালারিতে শোভা পাবে।
কল্পনা করলাম, আমাকে নিয়ে কতটা গর্ব বোধ করছেন বাবা-মা, সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টি।
আঙ্কেল-আন্টির কথা মনে পড়তেই আতঙ্কিত হলাম। এখন নিশ্চয় বনের মধ্যে রয়েছেন ওঁরা, নিশাচর জীবের ছবি তোলায় ব্যস্ত।
দুটো মায়ানেকড়ে যে বনে ঢুকেছে এটা নিশ্চয় জানেন না তাঁরা। জানেন না, পিশাচ দুটো শিকারের সন্ধানে বনে গেছে।
ওঁরা ওখানে নিরাপদ নন, বুঝতে পারলাম।
মায়ানেকড়ের পিছু নিয়ে বনে ঢোকাটা নিরাপদ তো নয়ই, স্রেফ পাগলামি, বুঝতে পারছি। কিন্তু ওদের পিছু নেয়াটা এখন আমার জন্য জরুরি। ছবি তোলার ব্যাপারটা তো আছেই, আঙ্কেল-আন্টিকেও সাবধান করে দিতে হবে।
ক্যামেরাটা কেসে ভরে কাঁধে ঝোলালাম। তারপর পিছনের আঙিনা ধরে এগিয়ে চললাম বনের দিকে, মায়ানেকড়ের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে। শিশিরে ভেজা মাটিতে ছাপগুলো খুব স্পষ্ট।
বনে ঢুকলাম। সেই পথটায় এসে পড়লাম, যেটা দিয়ে প্রথম দিন ঢুকেছিলাম। আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চললাম। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে আসছে চাঁদের আলো, মাটিতে বিচিত্র আলো-আঁধারি সৃষ্টি করেছে। কেমন ভুতুড়ে করে তুলেছে পরিবেশটা। ই মায়ানেকডে দুটোকে ধরতে বেশিক্ষণ লাগল না আমার। পুরানো। সেই বুড়ো-মানুষ গাছটার কাছে এসে ওদের ঘোঁতঘোঁত শুনতে পেলাম। তারপর হামলা চালানোর প্রাণ কাঁপানো গর্জন।
থমকে দাঁড়ালাম। উঁকি দিলাম ঝোপের আড়াল থেকে। মায়ানেকড়ে দুটোকে দেখলাম। মুখ হাঁ করে, থাবা বাড়িয়ে ঝাঁপ দিল ও দুটো।
কোনও প্রাণীকে আক্রমণ করেছে ওরা! কার ওপর হামলা চালাল? কোনও জানোয়ার? নাকি মানুষ! আমার আঙ্কেল-আন্টিকে আক্রমণ করেছে?