কোথাও আলো নেই। পিছনের স্টর্ম ডোরটা বন্ধ করেনি। বাতাসে বার বার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে পাল্লাটা, হাত নেড়ে যেন ডাকছে।
নিঃশব্দে চলে এলাম বাড়ির অন্যপাশে নিনার বেডরুমের জানালার কাছে। কাঁচের শার্সিতে চাঁদের রূপালী আলো পড়ে সাদা দেখাচ্ছে।
ভিতরে উঁকি দিয়ে কিছু দেখলাম না। তবে কয়েক ইঞ্চি খুলে রয়েছে জানালার পাল্লা।
নিনা? ফিসফিস করে ডাকলাম। নিনা, জেগে আছ?
ভিতরে নড়াচড়ার শব্দ হলো। পর্দা সরে গেল।
কে? ঘুমজড়িত স্বরে জিজ্ঞেস করল নিনা।
আমি পায়ের বুড়ো আঙুলের মাথায় ভর দিয়ে দেহটা উঁচু করলাম। রবিন! জানালার কাছে আসবে একটু?
রবিন? এত রাতে? নিনা জিজ্ঞেস করল।
উলফদের ছবি তুলব, বললাম ওকে। যাবে আমার সাথে?
ছবি? কিন্তু এত রাতে! আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…
প্রতি রাতেই ওদের বাড়ি থেকে নেকড়ের ডাক শুনি, আমি বললাম। তারপর কী যেন বেডরুমের জানালা দিয়ে মাটিতে লাফিয়ে নামে। সিডার আঙ্কেল বলেন; ওগুলো নাকি কুকুর…
আমি তো তোমাকে বলেছিই, বাধা দিয়ে বলল নিনা, উলফরা কুকুর পোষে না। তুমি যা দেখো, ওগুলো মায়ানেকড়ে। আমি জানি, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো না। কিন্তু যা বলি, সত্যি। সিডার আঙ্কেল আর জুলি আন্টিও জানেন, এটাই সত্যি। তুমি ভয় পাবে, সেজন্যে তোমাকে জানাতে চান না।
জলদি কাপড় পরে নাও, নিনা। বেরিয়ে এসো। আমি চাই, আমার মতই তুমিও নিজের চোখে দেখো মায়ানেকড়েগুলোকে।
তুমি পাগল, রবিন! বাড়ি যাও! জানালার কাছে এসে দাঁড়াল নিনা। খড়খড়ি আরও খানিকটা তুলে দিয়ে মুখ বের করল।
আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না, বলল ও। ভয়ানক বিপজ্জনক। বনের ভিতর মরা জানোয়ার পড়ে থাকতে দেখেছিলে না-কেটে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করা? উলফরা তোমাকে দেখতে পেলে তোমারও ওই অবস্থাই করবে।
ওর কথা শুনে ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল আমার। কিন্তু এ রহস্যের সমাধান আমাকে করতেই হবে। তা ছাড়া প্রতিযোগিতার জন্য ছবি তুলতে আমি মরিয়া। আমিই হব পৃথিবীর প্রথম ফটোগ্রাফার, যে মায়ানেকড়ের ছবি তুলতে পেরেছে।
আমাদের দেখবে না ওরা, নিনাকে বললাম। বাড়ির পাশের ঝোপের ভিতর লুকিয়ে থাকব।
আমার ভীষণ ভয় করছে, রবিন। আমি তোমার সঙ্গে যাব না। তুমিও যেয়ো না। বাড়ি ফিরে যাও।
প্লিজ! ওর হাত চেপে ধরলাম। বেরিয়ে এসো। তুমিও তো মায়ানেকড়ে দেখতে চাও, চাও না?
না! ঝাড়া দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিল নিনা। বাড়ি যাও। এটা ছেলেখেলা নয়। ভয়ানক বিপদে পড়বে।
শোনো, নিনা…
কিন্তু জানালা লাগিয়ে দিল ও। আরেকবার ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল আমার। ভুলই করছি হয়তো। উলফরা ধরতে পারলে…
চাপা গর্জন শুনে চমকে উঠলাম। জমে গেলাম বরফের মত।
একুশ
আরেকবার শোনা গেল চাপা গর্জন।
নিজের অজান্তেই চিৎকার বেরিয়ে গেল আমার মুখ দিয়ে।
হাঁটু ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে আমার। ভারি, কাঁপা কাঁপা, লম্বা দম নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম, ভূতুড়ে প্রাণীটার মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
কিন্তু না।
কি নেই ওখানে।
কিছুই নেই আমার পিছনে। তিনি
ঢোক গিলোম। মুখের ভিতরটা শুকনো কাঠের মত লাগছে।
আবার গর্জন শোনা গেল। উলফদের বাড়ির পিছন থেকে আসছে শব্দটা।
জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে তৈরি হচ্ছে ওরা, বুঝতে পারলাম। প্রতিরাতেই এই শব্দ শুনি আমি, যখন বেডরুমের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসে ওরা।
খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। বেরিয়ে প্রথমেই আমাকে চোখে পড়বে ওদের।
আমার পা কাজ করতে চাইল না। দাঁতে দাঁত চেপে, ভারি দম নিয়ে, মনের জোরে নিজেকে নড়ালাম।
ভেজা ঘাসে পিছলে যাচ্ছে আমার জুতো। আছাড় খেতে খেতে বাঁচলাম একবার।
একটা ঝোপের কাছে চলে এলাম। আমার আঙ্কেল-আন্টি ও উলফদের বাড়ির মাঝখানে রয়েছে ঝোপটা। এই
হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছি। বুকের মধ্যে এমনভাবে বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ডটা, বুক ব্যথা করতে লাগল।
মাথা নোয়ালাম। ক্যামেরা কেসের ফিতেটা চেপে ধরলাম।
তীক্ষ্ণ, দীর্ঘ একটা চিৎকার ভেসে এল উলফদের জানালার কাছ থেকে। চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওদের বাড়ির পাশটা।
আঙিনাটা প্রায় দিনের মত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শিশিরে ভিজে চিকচিক করছে সবকিছু।
ঝোপের আড়ালে বসে গাছের প্রতিটি পাতা, ঘাসের ডগা দেখতে পাচ্ছি আমি।
ক্যামেরা কেসের জিপার ধরে টানলাম। তাড়াতাড়ি বের করতে চাইলাম ক্যামেরাটা। হাতে বেশি সময় নেই। কিন্তু এমনভাবে হাত কাঁপছে, জিপার টেনে খুলতে পারলাম না। তিন
আরেকটা গর্জন জানালার দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করল আমাকে
একটা ছায়া নড়ল।
একটা পা বেরিয়ে এল। ক
আরেকটা পা। একটা ছায়ামূর্তি লাফিয়ে নামল মাটিতে। মনে অতি দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাগুলো। সময় যেন ছুটে চলেছে।
আমার চোখ জানালার দিকে। জিপার খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আরেকটা দেহ বেরিয়ে এল উলফদের ঘরের অন্ধকার জানালা দিয়ে। মাটিতে নামল।
দেহ টান টান করল মূর্তি দুটো। কারণ দুজন মানুষ। নেকড়ে নয়। মানুষ? পরনে কী ওদের? আলখেল্লা? লম্বা হয়ে ঝুলে আছে। আমার দিকে পিছন করে রয়েছে ওরা। মুখ দেখতে পাচ্ছি না।
দুই হাত কোমরে রেখে, পিঠ বাঁকা করে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে যেন লম্বা করে ফেলতে চাইছে পেশিগুলোকে।
তারপর চাঁদের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠল।