রাগে ঝটকা দিয়ে দরজার কাছ থেকে ঘুরে দাঁড়ালাম।
আমাকে তালা দিয়ে রেখে গেলেন কেন আঙ্কেল ও আণ্টি? অবাক লাগছে আমার। গতরাতে বেরিয়েছিলাম বলে? বনের ভিতর মরতে মরতে বেঁচেছিলাম, তাই?
ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলাম না। রাগে চিৎকার করে উঠলাম।
দৌড়ে গেলাম জানালার কাছে। পর্দা সরিয়ে খড়খড়ির হাতল চেপে ধরলাম। টান দিলাম ওপর দিকে।
কয়েক ইঞ্চি উঠে গেল খড়খড়ি। অস্ফুট শব্দ করে উঠলাম।
জানালাটায় লোহার ডাণ্ডা লাগানো।
নিশ্চয় আঙ্কেল লাগিয়েছেন। কখন লাগালেন? বিকেলে?
আমি এখন বন্দি, নিজেকে বললাম। খাঁচায় বদ্ধ জানোয়ারের মত আটকে রেখে যাওয়া হয়েছে আমাকে।
আবার চিৎকার করে উঠলাম অসহায় রাগে।
জানালার চৌকাঠে উঠে দাঁড়ালাম। দুই হাতে চেপে ধরে ডাণ্ডাগুলো টেনে খোলার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু নড়লও না ওগুলো।
ডাণ্ডা ধরে টানাটানি করছি, এই সময় কানে এল চাপা গর্জন।
ডাণ্ডা থেকে আপনাআপনি সরে এল আমার হাত। তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে গেল গলা চিরে।
বরফের মত জমে গেছি।
আবার শোনা গেল গর্জন। আগেরবারের চেয়ে জোরে।
কাছে। খুব কাছে।
তীক্ষ্ণ চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল। উলফদের বাড়ি থেকে আসছে।
মুখটা নিয়ে গেলাম ডাণ্ডার কাছে। উঁকি দিয়ে তাকালাম। ওদের বেডরুমের জানালা খুলে গেছে। তবে বাড়িটা পুরোপুরি অন্ধকার। কোথাও কোন আলো নেই।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অন্ধকারের দিকে। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি অস্পষ্টভাবে।
ডাণ্ডায় কপাল চেপে ধরে ভালমত দেখার চেষ্টা করলাম। জানোয়ারের ঘোঁতঘোঁত কানে এল। তারপর ধুপ করে একটা শব্দ।
উলফদের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছে একটা আবছা ছায়ামূর্তি। তারপর আরেকটা ধুপ। আরও একটা মূর্তি লাফিয়ে পড়ল জানালা দিয়ে, চারপায়ে ভর দেয়া।
একটা মূর্তি আকাশের দিকে মুখ তুলে তীক্ষ্ণ হাঁক ছাড়ল। বিলাপের মত মনে হলো ডাকটা।
হাঁটতে শুরু করল প্রাণী দুটো। চারপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পিছনের আঙিনা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে বনের দিকে।
কী ওগুলো? কুকুর? নেকড়ে? মানুষ? অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না।
তাকিয়েই আছি। রূপালী জ্যোৎস্না এসে যেন ধুয়ে দিতে লাগল। বাড়িটাকে। মেঘ সরে গেছে চাঁদের ওপর থেকে।
তবে দেরি হয়ে গেছে আমার। অনেক দেরি। প্রাণী দুটো উধাও। অসহায় আক্রোশে ডাণ্ডার ওপর কিল মারতে শুরু করলাম।
লেকের কিনারে আমার জন্য অপেক্ষা করছে টনি ও রজার। ওখানে যাবার কোন উপায় নেই আমার। অথচ যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছি আমি।
কী ভাববে ওরা? ভাববে আমি একটা ভীতুর ডিম। একটা দারুণ ছবি তোলা থেকে বঞ্চিত হলাম। রাগে দড়াম করে লাগিয়ে দিলাম জানালাটা।
কাল রাতে! জোরে জোরে বললাম। কাল রাতে অবশ্যই আমি বেরিয়ে যাব এখান থেকে। আঙ্কেল ও আন্টি ঠেকাতে পারবে না আমাকে।
কাল রাতে বনে যাব আমি, আবার বললাম নিজেকে।
মায়ানেকড়ের রহস্য ভেদ করে ছাড়ব!
আঠারো
দুঃস্বপ্ন দেখলাম। মায়ানেকড়ের তাড়া খেয়ে যখন পাগলের মত দৌড়াচ্ছি, হঠাৎ ভেঙে গেল ঘুম। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে। দেখি সিডার আঙ্কেলের বাড়িতে আমার ঘরে শুয়ে আছি। ঘামে নেয়ে গেছে সারা শরীর।
সকাল হয়ে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে এসে রান্নাঘরে ঢুকলাম। কী করে কাজটা করতে পারলেন! অভিযোগের সুরে বললাম। আমাকে না বলে আমার ঘরে তালা লাগালেন কেন?
হাতের কফির মগটা টেবিলে নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকালেন জুলি আন্টি। চোখে অস্বস্তি। ফিরে তাকালেন সিডার আঙ্কেলের দিকে। জন, মনে হচ্ছে ওকে সব বলে দেয়াই ভাল।
আমার দিকে চোখ সরু করে তাকালেন সিডার আঙ্কেল। কাল রাতেও কি বেরোনোর চেষ্টা করেছিলে তুমি?
ইয়ে… দ্বিধায় পড়ে গেলাম। আমি কী করার পরিকল্পনা করেছিলাম, ওঁদের বলা যাবে না। বললাম, আসলে ঘরটা তখন একটা খাঁচা মনে হচ্ছিল আমার। খাঁচায় থাকতে কার ভাল লাগে? আমার বয়েস বারো হয়ে গেছে, আমি আর এখন ছোট নই…
সরি বাধা দিয়ে বললেন জুলি আন্টি। রান্নাঘরের ঘড়িটার দিকে তাকালেন তিনি। একটা বড় বাটিতে আমাকে কর্নফ্লেক ঢেলে দিলেন।
তোমার ভালর জন্যেই আটকে রেখেছিলাম আমরা, সিডার আঙ্কেল বললেন। উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাতের ন্যাপকিনটা ভাজ করতে লাগলেন। এ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমাদের। আগের রাতের মত বনের ভিতর তোমাকে একা একা ঘুরতে দেয়া ঠিক হত না। রাতের বেলা বনটা নিরাপদ থাকে না।
তোমার দায়িত্ব এখন আমাদের ওপর, কর্নফ্লেকের বাটিটা টেবিলে আমার দিকে ঠেলে দিলেন জুলি আন্টি। তোমার আব্বা আম্মাকে আমরা কথা দিয়েছ তোমাকে নিরাপদে বাড়িতে ফেরত পাঠাব। তোমাকে আটকে রাখা হয়নি, রবিন। বরং আমরা চেয়েছি…
কিন্তু…কিন্তু…
আমি কথা শেষ করার আগেই.সিডার আঙ্কেল বললেন, তা ছাড়া গতকাল উলফরা পুলিশকে খবর দিয়েছে।
কী করেছে? চেঁচিয়ে উঠলাম। আমাকে বাধা দেয়ার জন্যে ওরা পুলিশকে খবর দিয়েছে?
মাথা ঝাঁকালেন আঙ্কেল। ওরা অভিযোগ করেছে, তুমি ওদের ওপর নজর রাখো।
ওরকম কিছুই করিনি আমি! রেগে গেলাম। কথাটা মোটেও ঠিক না। আমি ওদের ওপর নজর রাখিনি। আমি কিছুই করিনি।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, টেবিলের পাশ ঘুরে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন জুলি আন্টি। উলফদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। শুধু ওদের বাড়ির কাছে যেয়ো না, ব্যস।