জুলি আন্টি ও সিডার আঙ্কেল দুজনেই হাসতে লাগলেন। ওদেরকে হাসতে দেখে ভাল লাগল আমার। ডিনারের সময় খুব ক্লান্ত আর মন খারাপ দেখাচ্ছিল ওঁদের। আমার সঙ্গে প্রায় কথাই বলেননি।
বাতিল পুতুল নিয়ে একটা গানও আছে, জুলি আন্টি বললেন। তোমার মনে আছে, জন?
মাথা নাড়লেন সিডার আঙ্কেল। কোন কথাই আর এখন মনে করতে পারি না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার কথা যদি মনে থাকে, নিজেকে ভাগ্যবান ভাবব।
ধূর, তোমার সঙ্গে কথা বলে মজা নেই! জুলি আন্টি বললেন। কনুই দিয়ে আলতো গুতো মারলেন স্বামীর পিঠে। তারপর বাতিল পুতুলের গান ধরলেন।
কিম্ভুত ভঙ্গিতে কোমর দুলিয়ে হাত ওপরে তুলে নাচ আরম্ভ করল নিনা। সেলাই ছুটে গিয়ে জ্যাকেটের একটা হাতার অনেকখানি ঝুলে পড়ল। সবাই হাসলাম।
তোমার কস্টিউম কই, রবিন? জুলি আন্টি জিজ্ঞেস করলেন। যাও, গিয়ে পরে এসো। দেখি, কেমন লাগে।
আমি…আমি এখনও জোগাড় করতে পারিনি, বললাম।
চলল, কিছু পুরানো কাপড় নিয়ে আসি। আজ রাতেই তোমাকে একটা কস্টিউম বানিয়ে দেব, জুলি আন্টি বললেন।
কিন্তু কস্টিউম নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার। সামনের জানালা দিয়ে বার বার অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকাচ্ছি। কী করতে যাচ্ছি, ভাবছি।
বনের ভিতর লেকের কাছে টনি ও রজারের সঙ্গে দেখা করার কথা আমার। স্কুলে ওদের সঙ্গে এই কথাই হয়েছে। সাথে করে ক্যামেরাটা নিয়ে যেতে হবে আমাকে।
ওরা বলেছে, প্রতি রাতেই চাঁদ যখন মাঝ আকাশে ওঠে, মায়ানেকড়ে আসে ওই জায়গাটাতে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ে, কথাটা বলার সময় উত্তেজনায় ফিসফিসে হয়ে গিয়েছিল রজারের কণ্ঠ। তারপর মুখ নামিয়ে চুক চুক করে লেকের পানি খায়।
দাঁড়াও না, আগে দেখো ওটাকে, তারপর বুঝবে কী জিনিস! টনি বলেছে। আধা-নেকড়ে আধা মানুষ! বুঝলে তো? আধা-জম্ভ আধা মানুষ!
দুজনের দিকে চোখ সরু করে তাকিয়েছি। ওরা সত্যি বলছে কিনা বোঝার চেষ্টা করেছি। ভাবভঙ্গি দেখে ধাপ্পা মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল, সত্যি কথাই বলছে।
কিন্তু এটা কি সম্ভব? সত্যিই কি আছে মায়ানেকড়ে?
উলফদের জানালায় দেখা অদ্ভুত প্রাণীটার কথা ভাবলাম। বনের ভিতরে দুটো প্রাণীর হিংস্রতার কথাও ভাবলাম। ঘাড়ের কাছে শিশির করে উঠল আমার।
মাঝরাতে দেখা করবে আমাদের সঙ্গে? টনি জিজ্ঞেস করেছিল।
রাতের বেলা বনে যাবার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না, বিশেষ করে একবার ঘুরে সেখানে কী আছে দেখে আসার পর।
কিন্তু আমি যে ভয় পেয়েছি সেটা জানতে দিতে চাইনি ওদের।
তা ছাড়া প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য একটা অন্যরকম ছবি আমার দরকার। মায়ানেকড়ের ছবি নিয়ে যেতে পারলে নিঃসন্দেহে প্রথম পুরস্কার পাব! এর ধারেকাছেও আসতে পারবে না অন্য কোন ছবি।
কাজেই চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনের মধ্যে দেখা করব। কথা দিলাম টনি ও রজারকে। কিন্তু যতই অন্ধকার হচ্ছে, ততই আমার ___ অস্বস্তি বাড়ছে। এ জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে পেটের ভিতরে মোড় দিতে থাকল আমার। ঠাণ্ডা হয়ে গেল হাতের তালু। ঘামে আঠা হয়ে যাচ্ছে।
রবিন, কী ভাবছ? জুলি আন্টির প্রশ্নে ভাবনার জাল ছিন্ন হয়ে গেল আমার।
অ্যাঁ! চোখ মিটমিট করে তাকালাম। মাথা ঝাড়লাম।
হেসে উঠল সবাই।
জানালা দিয়ে এমন করে বাইরে তাকিয়ে আছ যেন ভূত দেখেছ, নিনা বলল।
না, চাঁদ দেখছিলাম, কোনমতে বললাম।
একে বলে চাঁদের অসুখ! রসিকতা করলেন সিডার আঙ্কেল।
ঘরের সবাই ভাল মেজাজে আছে, শুধু আমি বাদে। মনে হলো, আমারও ওদের সঙ্গে যোগ দেয়া দরকার। কিন্তু বনের ভিতরে যাওয়ার ভাবনাটা আমাকে সহজ হতে দিল না।
একটু পরে বাড়ি চলে গেল নিনা। আণ্টি ও আঙ্কেলকে গুড-নাই। জানিয়ে আমিও নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।
বিছানার পাশে রাখা টেবিল ঘড়িটা দেখলাম। দশটা বেজে পনেরো।
আরও অন্তত দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
ক্যামেরাটা পরীক্ষা করে নিলাম। নিশ্চিত হলাম, হাই-স্পিড ফিল্ম ভরা আছে।
তারপর একটা ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিন টেনে নিয়ে পড়তে বসলাম। দ্রুত সময় পার করে দেয়ার জন্য।
কিন্তু আমার চোখ দুটোই শুধু তাকিয়ে আছে ম্যাগাজিনের দিকে। পড়তে পারছি না। মনোযোগ দিতে পারছি না।
একটু পর পরই ঘড়ির দিকে নজর চলে যাচ্ছে, কটা বাজে দেখার জন্য।
অপেক্ষার মুহূর্তগুলো এত দীর্ঘ হয় কেন?
অবশেষে, বারোটা বাজার দশ মিনিট আগে ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে রাখলাম। গায়ে একটা বাড়তি সোয়েটার চাপালাম। তার ওপরে জ্যাকেট। ক্যামেরা কেসটা তুলে নিয়ে কাঁধে ঝোলালাম। আলো নিলাম। তারপর পা টিপে টিপে এগোলাম বেডরুমের দরজার দিকে।
এতক্ষণে নিশ্চয় বনে চলে গেছেন আমার আঙ্কেল ও আন্টি, নিশাচর জীবের ছবি তুলতে। কিন্তু ঝুঁকি নিলাম না। যদি ঘরে থেকে থাকেন। সেজন্য নিঃশব্দে চললাম, যাতে ওঁরা শুনে না ফেলেন।
অন্ধকারে দরজার নব ধরে মোচড় দিয়ে টান দিলাম।
নব ঘুরল, কিন্তু দরজা খুলল না।
আরে!
আবার মোচড় দিয়ে হ্যাঁচকা টান দিলাম।
এবারও খুলল না।
বিশ্বাস করতে পারছি না।
দরজায় তালা দিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে বেরোতে না পারি।
সতেরো
নাকি পাল্লাটা আটকে গেল?
জোরে জোরে টানতে লাগলাম। জোরে ধাক্কা দিয়েও দেখলাম। কোন কাজ হলো না। পাল্লা খুলল না। তালাই দেয়া হয়েছে। বাইরে থেকে।