মেয়েরাও? নিনা জিজ্ঞেস করল।
হেসে উঠল কয়েকটা ছেলেমেয়ে।
হ্যাঁ, মেয়েরাও, গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন মিস্টার রোভার। মায়ানেকড়েদের অতিরিক্ত রাগ। বার বার চিৎকার করতে থাকে। শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় বনের ভিতর।
গাঁজা! বিড়বিড় করল সামনের সারিতে বসা একটা ছেলে।
হেসে উঠল অনেকেই।
টিচার হাসলেন না। অনেকে আবার জাদু করা নেকড়ের চামড়া পরেও মায়ানেকড়ে হয়, বলতে থাকলেন তিনি। চামড়া পরে পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনবার নেকড়ের মত জোরে জোরে হাঁক দিলেই সে মায়ানেকড়ে হয়ে যাবে। গা থেকে চামড়া খুলে নিলে আবার মানুষের রূপ ফিরে পাবে। এভাবে চামড়া পরে যারা মায়ানেকড়ে হয়, তাদের বেশির ভাগই অতি কৌতূহলের শিকার। ওই চামড়া কোনভাবে পুড়িয়ে ফেলা গেলে গায়েও দিতে পারবে না, আর মায়ানেকড়েও হতে পারবে না। এক ভয়ানক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবে।
গুল! আবার বলল লাল চুলওয়ালা ছেলেটা।
অনেকেই হাসল। উত্তেজিত স্বরে কথা বলতে লাগল ছেলেমেয়েরা।
থামানোর চেষ্টা করলেন মিস্টার রোভার। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হলুদ সোয়েটারের নীচের দিকটা টেনে নামিয়ে দিলেন। পায়চারি শুরু করলেন চকবোর্ডের সামনে।
মায়ানেকড়ে আছে, কে কে বিশ্বাস করো? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
খুক করে চাপা হাসি হাসলাম। আমার ধারণা কেউ হাত তুলবে না।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘরের বেশির ভাগ ছেলেকে হাত তুলল।
তোমরা বিশ্বাস করো! মিস্টার রোভার জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, করি, রজার বলল।
আমিও করি, সুর মেলাল টনি।
ফিরে তাকিয়ে দেখলাম কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনে।
শিহরণ খেলে গেল আমার দেহে। সমস্যাটা কী ওদের? অবাক হয়ে ভাবলাম। এমন উদ্ভট আচরণ করছে কেন?
.
ক্লাস শেষ হলে ঘরের পিছনে আমার কাছে চলে এল রজার ও টনি। ঘরের বাইরে লকারের দরজা লাগানোর জোরাল শব্দ হচ্ছে। হাসাহাসি করছে ছেলেমেয়েরা, উঁচু স্বরে কথা বলছে। দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে। ওদের হট্টগোল।
চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে।
ব্যাকপ্যাকের জিপার লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?
আমাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে বেরিয়ে গেলেন মিস্টার রোভার। এক হাতে ব্রিফকেস। ক্লাসরুমে আমরা তিনজন ছাড়া কেউ নেই।
কেমন লাগছে? টনি জিজ্ঞেস করল।
নতুন স্কুলে সবকিছু নিশ্চয় অন্যরকম লাগছে? রজারের প্রশ্ন।
হ্যাঁ, কিছুটা, জবাব দিলাম। তবে এ নিয়ে ভাবছি না, দু-তিন সপ্তাহের বেশি তো আর এখানে থাকতে হচ্ছে না আমাকে।
তোমার ভাগ্য ভাল, চলে যাওয়ার সুযোগ আছে, রজার বলল। টনি আর আমি পড়ে গেছি ফাঁদে। আটকে গেছি এই জঘন্য জায়গাটায়। কোনও দিন আর এখান থেকে বেরোতে পারব বলে মনে হয় না।
অত খারাপ নয় কিন্তু উলফ লেক। ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে তুলে নিলাম আমি।
আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাৰিয়ে আছে ছেলে দুটো। ঢালা প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল টনি। রজার কড়ে আঙুলে পরা একটা রূপার আংটি ঘুরিয়ে চলেছে অনবরত।
অবশেষে নীরবতা ভাঙল টনি। মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, মায়ানেকড়ে আছে, বিশ্বাস করো না তুমি, তাই না?
আমি? আসলে… বলতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
তুমি তো হাত তোলনি, রজার বলল। তারমানে তুমি বিশ্বাস করো না।
আসলেই আমি বিশ্বাস করি না, জবাব দিলাম। একুশ শতকে এসে এই কম্পিউটারের যুগে কে বিশ্বাস করবে মানুষ নেকড়ে হয়ে যায়? না, আমি করি না। আমি জানি, আমার জায়গায় কিশোর হলেও ঠিক এই জবাবটাই দিত।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে ওরা।
কিন্তু মায়ানেকড়ে আছে, গম্ভীর মুখে বলল রজার। আমরা সেটা প্রমাণ করতে পারব।
কেন বাজে বকছ?
বললাম তো, প্রমাণ করতে পারব, রজার ওর কথায় অটল। থাকল। একটা মায়ানেকড়ে আমি তোমাকে দেখাতেও পারব।
একটা সত্যিকারের মায়ানেকড়ে, টনি বলল।
থাক, লাগবে না, আমি বললাম। আমি…
চাইলে ওটার ছবিও তুলতে পারবে তুমি, বাধা দিয়ে বলল রজার।
হ্যাঁ। যত ইচ্ছে ছবি, সুর মেলাল ওর বন্ধু।
তর্ক থামিয়ে চুপ করে ভাবতে লাগলাম। ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় মায়ানেকড়ের ছবি দেখাতে পারলে আমার প্রথম পুরস্কার পাওয়া ঠেকায় কে?
সত্যিকারের একটা মায়ানেকড়ে দেখতে চাও? টনি জিজ্ঞেস করল।
মায়ানেকড়ের ছবি তুলতে চাও? সুর মেলাল রজার।
আমার দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে।
চাই, কোনরকম দ্বিধা না করে জবাব দিলাম।
ষোলো
হেসে উঠলেন জুলি আন্টি। নিনা, অদ্ভুত লাগছে তোমাকে! গালে হাত ঠেকালেন তিনি।
থ্যাংক ইউ। নাটকীয় ভঙ্গিতে বাউ করল নিনা। থ্যাংক ইউ।
ডিনারের পর কস্টিউম দেখাতে এসেছে ও। হ্যালোউইনের সময় কী পরবে দেখাচ্ছে। বেশ কিছু পুরানো পোশাক থেকে কাপড় ছিঁড়ে জোড়া দিয়ে সেলাই করেছে। ঢোলা প্যান্টের এক পা বাদামী আরেক পা সবুজ। হাঁটুর কাছে চেক কাপড়ের তালি। হলুদ, লাল, নীল, সবুজ এমন কোনও রঙ নেই, যে রঙের কাপড় নেই শার্টটাতে। শার্টের ওপর জ্যাকেট পরেছে, ওটা আরও বেশি রঙচঙে। পুরানো কম্বল কেটে বানানো হ্যাটটা বার বার কাত হয়ে গিয়ে মুখের ওপর এসে পড়ছে।
আসলে কী সেজেছ তুমি? জিজ্ঞেস করলাম। বাতিল কাপড়ের আড়ত?
নিনা হাসল না। পুরানো বাতিল পুতুল। চিনতে পারছ না? কম্বলের কাপড়ের একটা ছেঁড়া মাথা ধরে টান দিল ও।