আমার ব্যাকপ্যাক আর জ্যাকেট নিয়ে, জুলি আণ্টি ও সিডার আঙ্কেলকে গুডবাই জানিয়ে সামনের দরজার দিকে রওনা হলাম।
বাইরে এসে গেটের দিকে এগোলাম। ফিরে তাকালাম উলফদের বাড়ির দিকে। বেডরুমের যে জানালাটা খোলা দেখেছিলাম, সেটা এখন বন্ধ। পুরো বাড়িটা অন্ধকার, সব সময় যেমন থাকে।
তোমার ক্যামেরাটা পেলে? নিনা জিজ্ঞেস করল।
মাথা ঝাঁকালাম। হ্যাঁ। কিন্তু মরতে মরতে বেঁচেছি। গতরাতের ভয়াবহ অভিযানের কথা খুলে বললাম ওকে।
গম্ভীর হয়ে গেল নিনা। তোমাকে আমি আগেই সাবধান করেছিলাম, রবিন। রাতের অন্ধকারে ভয়ানক হয়ে যায় বনটা।
হলুদ রঙের একটা স্কুল বাস ভারি শব্দ তুলে পাশ কাটাল আমাদের। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নিনার নাম ধরে ডাকল কয়েকটা ছেলেমেয়ে। ওদের উদ্দেশে হাত নাড়ল নিনা।
আকাশের অনেক নীচে ঝুলে আছে যেন সকালের সূর্যটা। রাস্তার পাশের ঘাস আঁকড়ে রয়েছে শিশিরকণা। ঠাণ্ডা বাতাস যেন মচমচে, চাপ দিলেই ভেঙে যাবে।
আরেকটা ব্লক পেরোলেই স্কুলে পৌঁছে যাব, নিনা বলল। অস্বস্তি লাগছে?
জবাব দিলাম না। উলফদের কথা ভাবছি আমি। ওদের বাড়ির ভিতর থেকে আসা চিৎকারের কথা জানিয়ে নিনাকে বললাম, দুটো জার্মান শেফার্ড কুকুর নাকি আছে ওঁদের। যেমন বড়, তেমনি হিংস্র।
কে বলল ওদের কুকুর আছে? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল নিনার কণ্ঠ।
থমকে দাঁড়ালাম। কী বললে?
উলফদের কোন কুকুরই নেই, নিনা বলল আবার। কখনও কুকুর পুষতে দেখিনি ওঁদের।
তা হলে আমার আঙ্কেল বললেন কেন?
যাতে তুমি ভয় না পাও, নিনা বলল।
উলফদের যদি কুকুর না থাকে, অদ্ভুত ওই পায়ের ছাপগুলো তা হলে কীসের?
মাথা নাড়ল নিনা। ওর জলপাই-সবুজ চোখের তারা স্থির হলো, আমার চোখের দিকে। রবিন, এখনও বুঝতে পারনি? কিছুই অনুমান করতে পারনি?
কী অনুমান করব? বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম।
উলফরা মায়ানেকড়ে!
পনেরো
অবাক হলাম আমি। তবে বিশ্বাস করলাম না। হেসে উড়িয়ে দিলাম নিনার কথা। এই কম্পিউটারের যুগেও মায়ানেকড়ের কথা বিশ্বাস করে মানুষ?
উলফ লেকের মানুষরা করে, নিনা বলল।
তুমি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ, বললাম ওকে। কিন্তু এত সহজে আমি ভয় পাই না। একটা জার্মান শেফার্ডকে আমি দেখেছি। উলফদের জানালার কাছে এসে চিৎকার করছিল।
হতাশ ভঙ্গিতে মুখ বাঁকাল নিনা। ওটা কুকুর না।
তা হলে কী? মায়ানেকড়ে? অন্যে যে যা বলে বলুক, তুমি অন্তত ওসব আজগুবি কথা বলে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা কোরো না, বুঝলে? সব
কিন্তু স্কুলে একটা মস্ত চমক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, এমনকী সিক্সথ গ্রেডের শিক্ষক মিস্টার রোভার পর্যন্ত সারাটা সকাল মায়ানেকড়ের আলোচনা করে কাটালেন।
চল্লিশের কাছাকাছি বয়েস তাঁর। বেঁটে, মোটা। পাতলা হয়ে আসা বাদামী চুল। গোলাকার লাল মুখ। চশমার পুরু কাঁচের ওপাশে কালো চোখ। গায়ে হলুদ সোয়েটার। সব মিলিয়ে তাকে একটা পাকা নাশপাতির মত মনে হলো আমার।
কি তবে নিনা ঠিকই বলেছে। মানুষ হিসেবে তিনি অতি চমৎকার। আন্তরিক ভঙ্গিতে আমাকে স্বাগত জানালেন তিনি। ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দ্রুত পরিবেশটা সহজ করে দিলেন আমার জন্য।
পিছনের দরজার কাছে একটা সিট ঠিক করে দিলেন আমাকে। নিনা বসে সামনের সারিতে।
ঘরের অন্যপ্রান্তে জানালার কাছে বসা দেখলাম রজার ও টনিকে। আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল ওরা, তবে হাই-হ্যালো কিছু বলল না।
কেমন দুমড়ানো, ক্লান্ত মনে হলো ওদেরকে। পরনের পোশাক অতিরিক্ত কুঁচকানো। এলোমেলো, উস্কোখুস্কো চুল। সারারাত মনে হয় জেগেই ছিল, ভাবলাম।
এই আজব ভাবনা কেন এল আমার মাথায়, বুঝলাম না।
নাম ডাকার পর নিজের ডেস্কের কিনারে উঠে বসলেন মিস্টার রোভার। পুরো ঘরে ঘুরে এল তার নজর। আমাদের সুস্থির হয়ে বসার সুযোগ দিলেন।
লাইক্যানথ্রপি কি জিনিস জানো তোমরা? ভারি পাওয়ারের কাঁচের ওপাশে জ্বলজ্বল করে উঠল তাঁর চোখ। ] তারই
শব্দটা জীবনে প্রথম শুনলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে কয়েকটা হাত উঠে গেল।
রজারকে বলতে বললেন টিচার।
লাইক্যানথ্রপি মানে মানুষের নেকড়েতে রূপান্তরিত হওয়া, জবাব দিল রজার।
অর্থাৎ মায়ানেকড়ে! বলল টনি।
মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার রোভার। হ্যাঁ, মায়ানেকড়ে। অনেকে। লাইক্যাপি স্টাডি করে। কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন তিনি। যেহেতু এ সপ্তাহের শেষেই হ্যালোউইন-আর এ বছর হ্যালোউইনের রাতেই হচ্ছে পূর্ণিমা-ভাবলাম, কিছুটা সময় লাইক্যানথুপি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করে, মায়ানেকড়েকে জ্যান্ত করে তুলতে পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদের প্রয়োজন। তবে তাদের ধারণা ভুল। যদিও একটা কথা ঠিক, চাঁদ যত বড় হতে থাকে, মায়ানেকড়েরাও ততই শক্তিমান হতে থাকে।SIR
পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসলেন তিনি। দুশো বছর আগে ইয়োরোপে কীভাবে মায়ানেকড়ের কিংবদন্তী চালু হয়, সেই গল্প বললেন। জ্যোৎস্নারাতে একজন স্বাভাবিক মানুষ মায়ানেকড়ের কামড় খেলে সে-ও মায়ানেকড়ে হয়ে যায়।
কামড় খেয়ে যারা মায়ানেকড়ে হয়, তাদের এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় নেই, মিস্টার রোভার বললেন। চাপকণ্ঠে। কথা বলছেন তিনি, যেন আবহটাকে ভূতুড়ে রূপ দিতে চাইছেন। একবার মায়ানেকড়ে হয়ে গেলে যতই স্বাভাবিক জীবন যাপনের চেষ্টা সে করুক না কেন, চাঁদের আলোয় নেকড়ে হবেই।