কয়েক মিনিট পরেই বন থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে এলাম। পৌঁছে গেলাম আমার আঙ্কেল সিডারের বাড়ির পিছনের আঙিনায়।
খুব খুশি লাগছে! উড়তে ইচ্ছে করছে!
ঘরের ভিতরের উষ্ণতায় পৌঁছানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি। ভেজা কাপড় খুলে শুকনো কিছু পরতে না পারলে শান্তি নেই।
কিন্তু আঙিনার মাঝামাঝি পৌঁছে থমকে দাঁড়ালাম।
তাকিয়ে আছি আমার টর্চের গোলাকার আলোটা যেখানে পড়েছে। সেদিকে।
ভেজা ঘাসে অদ্ভুত কিছু পায়ের ছাপ। গম্ভীর হয়ে বসা ছাপগুলো চলে গেছে উলফদের বাড়ির দিকে।
ভাল করে দেখার জন্য নিচু হলাম। মানুষের পায়ের ছাপের মত লাগল না ওগুলো। অনেকটাই লম্বা, চওড়াও বেশি, মানুষের পা কিংবা জুতোর চেয়ে অন্যরকম।
জানোয়ারের পায়ের ছাপ। আলোটা সামনে বাড়িয়ে রেখে পায়ের ছাপ ধরে এগিয়ে চললাম। চলে এলাম উলফদের আগাছা জন্মে থাকা পিছনের আঙিনায়। অদ্ভুত ছাপগুলো কোথায় গেছে দেখে আরেকবার অবাক হলা। সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে উলফদের শোবার ঘরের জানালায়।
চোদ্দো
পরদিন সকালে নাস্তা করতে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি ফোনে কথা বলছেন জুলি আন্টি। আমার দিকে পিছন করে আছেন। আমি আঙ্কেলকে গুড মর্নিং বলতেই আন্টি ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। রাগ ঝিলিক দিয়ে উঠল চোখের তারায়।
হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি, ফোনে বললেন তিনি। ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর কখনও ঘটবে না এ রকম।
সিডার আঙ্কেলের পাশে বসলাম। সাদা একটা কফির মগে চুমুক দিচ্ছেন। চোখ জুলি আন্টির দিকে।
না, আর ঘটবে না, টেলিফোনে আবার বললেন জুলি আন্টি। ভুরু কোঁচকালেন। আর যেন না যায় দেখব আমি। না। আপনার ওপর নজর রাখেনি, মিস্টার উলফ।
বুঝলাম, কার সঙ্গে কথা বলছেন আন্টি।
অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সিডার আঙ্কেল। আমি তোমাকে ওই বাড়িটার কাছে যেতে নিষেধ করেছিলাম, রবিন। আমি চাই না ওরা আমাকে ফোন করুক।
সরি, বিড়বিড় করলাম। কিন্তু…
গতরাতে যা ঘটেছে সব তাঁকে জানাতে চাইলাম। যা যা দেখেছি, সব।
কিন্তু ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে চুপ থাকতে ইশারা করলেন আঙ্কেল। আন্টি যতক্ষণ ফোনে কথা বলছেন, ততক্ষণ যাতে কিছু না বলি।
না। আমার ভাতিজা আপনার বাড়ির ছবি তোলেনি, মিস্টার …, উলফ, জুলি আন্টি বললেন। না, বললাম তো, আর আপনাকে বিরক্ত করবে না। এখুনি ওর সঙ্গে কথা বলছি আমি। হ্যাঁ। ঠিক আছে। গুড বাই।
রিসিভার রেখে সিডার আঙ্কেলের দিকে তাকালেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিড়বিড় করলেন, কী লোক।
সাবধান হতে হবে আমাদের, জবাব দিয়ে চোখের পাতা সরু করে আমার দিকে তাকালেন সিডার আঙ্কেল। ওদের কিছু করতে দেয়া চলবে না।
কিন্তু আমি অদ্ভুত জিনিস দেখেছি… বলতে গেলাম।
শুনলেন না আঙ্কেল। বাধা দিয়ে বললেন, ওরা তোমাকে দেখে ফেলেছে, রবিন। কাল রাতে নাকি ওদের বাড়ির কাছে ঘোরাফেরা করছিলে। ভীষণ রেগে গেছে তাতে।
মগে কফি ঢেলে নিয়ে টেবিলে এসে বসলেন জুলি আন্টি। কপালে এসে পড়া এক গাছি ধূসর চুল হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন।
ও কাল রাতে বাইরে গিয়েছিলে কেন? আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন।
আমি সত্যি দুঃখিত। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। আমার ক্যামেরাটা বনে ফেলে এসেছিলাম। সারারাত বনে পড়ে থাকলে, বৃষ্টির মধ্যে, নষ্ট হয়ে যেত।
কিন্তু উলদের বাড়ির কাছে গিয়েছিলে কেন? জুলি আন্টি জিজ্ঞেস করলেন।
বুনো জানোনায়ারের চিৎকার শুনলাম ওঁদের বাড়ির ভিতরে। অদ্ভুত পায়ের ছাপ গিয়ে শেষ হয়েছে বেডরুমের জানালার নীচে।
শান্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন সিডার আঙ্কেল। কফির কাপে লম্বা চুমুক দিলেন। নিশ্চয় ওদের কুকুরের পায়ের ছাপ, বলে জুলি আন্টির দিকে তাকালেন তিনি।
কুকুর? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। শুভ।
মাথা ঝাঁকালেন দুজনেই। মস্ত দুটো জার্মান শেফার্ড কুকুর আছে ওদের, জুলি আন্টি বললেন। সাংঘাতিক হিংস্র।
নেকড়ের মত বড়, সিডার আঙ্কেল বললেন। এক টুকরো টোস্ট নিয়ে তাতে মাখন লাগানো শুরু করলেন।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। দুটো জার্মান শেফার্ড! তীক্ষ্ণ চিৎকার আর ভেজা ঘাসে পায়ের ছাপের একটা মানে পাওয়া গেল এতক্ষণে। কিন্তু কেন যেন মনটা খুঁতখুঁত করতেই থাকল আমার।
স্কুলে যাবে না? জুলি আন্টি জিজ্ঞেস করলেন। যে কোন সময় নিনা চলে আসবে।
আমি রেডি, জবাব দিলাম। ঢক ঢক করে শেষ করে ফেললাম এক গ্লাস কমলার রস। গত রাতে আমি যখন বনের ভিতর গিয়েছিলাম… এ দুজনকে হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে থেমে গেলাম।
তারপর বললাম, একটা জানোয়ারকে দেখলাম ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়েছে ওটাকে।
মাথা ঝাঁকালেন সিডার আঙ্কেল। মৃদুস্বরে বললেন, রাতের বেলা বন খুব বিপজ্জনক হয়ে যায়।
বা রাতের বেলা তোমার বনে যাওয়া আমাদের পছন্দ না, রবিন, আমার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে জুলি আন্টি বললেন, কথা দাও, আর কখনও যাবে না।
যাব না, বিড়বিড় করলাম। আ মি ই আমি জবাব দেবার আগেই দরজার ঘণ্টা বাজল। রান্নাঘরে ঢুকল নিনা। জিনিসপত্রে ফুলে থাকা একটা ব্যাকপ্যাকের ভারে বাঁকা হয়ে আছে।রেডি?
মাথা ঝাঁকিয়ে চেয়ার পিছনে ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, রেডি। কেমন জানি লাগছে আমার, একটা অপরিচিত স্কুলে যেতে।
টিচার মিস্টার রোভারকে তোমার ভালই লাগবে, নিনা বলল। ভারি মজার লোক। আর খুব ভাল মানুষ।