আমি ঠিক আছি, নিজেকে বোঝালাম। আপাতত আমি নিরাপদ।
গভীর অন্ধকারে কী আছে দেখার চেষ্টা করছি।
আর ঠিক এই সময় মাথায় পড়ল ওটা।
বারো
চমকে গিয়ে প্রথমে চিৎকার করে উঠলেও পরে বুঝলাম জিনিসটা কী। একটা পাখির বাসা। মাটি দিয়ে তৈরি ভাঙা বাসাটা মাথার ওপরের কোনও ডাল থেকে খসে পড়েছে বাতাসে।
কিন্তু কী কাণ্ড! পড়ার আর সময় পেল না! আর পড়বি তো পড়, একেবারে আমারই মাথায়!
চুলে আটকে যাওয়া একটা শুকনো কুটো ঝেড়ে ফেললাম। ক্যামেরাটা শক্ত করে চেপে ধরে চারপাশে তাকালাম।
কোথায় রয়েছি?
সামনের গাছগুলো কেমন বেঁকে রয়েছে মনে হচ্ছে। যেন হেলে পড়তে চাইছে একে অন্যের গায়ের ওপর। নলখাগড়া বনের কিনারে নিচু একটা পাথরের স্তূপ চোখে পড়ল।
হারিয়ে গেছি, বুঝতে পারলাম। তার
আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদ নেই। ভারি মেঘে ঢাকা পড়েছে চাঁদ-তারা সব কিছুই। আবছা আভা ছড়িয়ে আছে বনতলে।
ফিরে যাব কীভাবে?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকালাম। রাস্তা খুঁজলাম। পরিচিত কিছু খুঁজলাম।
কিছুই দেখলাম না।
লেকটা খুঁজে পেলে হয়তো পরিচিত সেই জায়গাটায় ফিরে যেতে পারব, যেখানে বুড়ো বাঁকা গাছটা রয়েছে, যেখানে ক্যামেরাটা পেয়েছি।
কিন্তু কোনদিকে রয়েছে উলফ লেক?
পুরো এক পাক ঘুরে চারপাশে তাকালাম।
গায়ে কাঁটা দিল। জ্যাকেটে ঝরে পড়ল বৃষ্টির ঠাণ্ডা ফোঁটা।
আবারও চমকে গেলাম।
যা পড়ছে, তাতেই চমকাচ্ছি।
কী করব?
বনবন করে ঘুরছে যেন মগজটা।
চিৎকার করে ডেকে সাহায্য চাইব?
আমার আঙ্কেল-আন্টিকে ডাকব? জোরে চেঁচালে হয়তো আমার ডাক তাদের কানে পৌঁছবে।
কিন্তু আমার চিৎকার সেই জানোয়ারটার কানেও যেতে পারে।
এখনও কি আমাকে খুঁজছে ওটা? কাছাকাছিই কোথাও আছে?
সাহায্যের জন্য চিৎকার করলে বিপদ বাড়ার সম্ভাবনা আছে ভেবে বাদ দিলাম চিন্তাটা। রাত
কী করব তা হলে এখন? কী?
যে কোনও একদিকে হাঁটা শুরু করব? তারপর যা হয় হোক?
না। আন্দাজে ওরকম হাঁটতে গেলে পথ হারানোর সম্ভাবনা বেশি। ভোর হওয়ার অপেক্ষা করাই ভাল। এই অন্ধকারে কোনভাবেই বাড়ি ফিরতে পারব না। দিনের আলোয় পথ চিনে যাওয়াটা সহজতর হবে।
কিন্তু বনের ভিতর রাত কাটানোটাও ভীষণ বিপজ্জনক। টুপুর টাপুর শব্দ শোনা গেল আবার। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বেশ জোরেই নেমেছে এবার। বরফের মত ঠাণ্ডা পানি, ঝোড়ো বাতাসের ঝাঁপটায় সুচের মত বিধছে মুখে।
এখানে থাকা যাবে না, বুঝতে পারলাম।
বাড়ি যাওয়ার চেষ্টাই করতে হবে। হাঁটতে শুরু করলাম। তাড়াহুড়া না করে সাবধানে হাঁটছি। যেদিক থেকে এসেছি, সেদিকেই যাচ্ছি কিনা জানি না। তবে পরিচিত ঝোপটা চিনতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এখানে বসেই জানোয়ারের গর্জন শুনেছিলাম। ভাগ্য ভাল, টর্চটাও খুঁজে পেলাম। এমন জোরে আঁকড়ে ধরলাম, যেন ওটাই আমার জীবন-মরণ।
এরপর কোনদিকে যাব? অনুমানের ওপর নির্ভর করে আবার চলা শুরু করলাম।
মিনিটখানেক পরেই কোন কিছুতে হোঁচট খেলাম।
নরম কোনকিছু।
কীসে হোঁচট খেয়েছি দেখতে গিয়ে আতঙ্কিত চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
তেরো
টর্চলাইটটা কাঁপছে হাতের মুঠোয়। কাঁপা আলোয় বীভৎস একটা দৃশ্য ফুটে উঠল চোখের সামনে।
হাঁ করে তাকিয়ে আছি একটা জানোয়ারের দেহের দিকে। না না, দুটো জানোয়ার। কী কী ওগুলো? চেনা কঠিন। নখ দিয়ে কেটে ফালাফালা করে ফেলা হয়েছে।
টুকরো টুকরো করে ভেঁড়া। দড়ি
মাংস ঘেঁড়ার শব্দ শুনেছিলাম, মনে পড়ল। এগুলোকেই ছিঁড়ছিল জানোয়ারটা। পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল।
কী ধরনের জানোয়ার ওটা?
অন্য জানোয়ারকে এভাবে ছিঁড়ে ফেলতে পারে, কোন ধরনের জীবের এত শক্তি?
শিরশির করে উঠল মেরুদণ্ড।
জোর করে দৃষ্টি সরালাম অন্য দিকে।
একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে এখন। ক্যামেরাটা জ্যাকেটের নীচে ঢোকালাম। দৌড়াতে শুরু করলাম আবার।
ভয়ঙ্কর এই দৃশ্য সহ্য করা যায় না। যতটা সম্ভব দূরে পালাতে হবে।
চারপাশ থেকে ঝাঁপটা মারছে বৃষ্টিমেশানো বাতাস। আগে বাড়তে দিতে চায় না যেন আমাকে। কিন্তু আমিও থামব না। তাই
ভয় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল।
ওই ভয়াল জানোয়ারটা এখনও নিশ্চয় ঘুরে বেড়াচ্ছে বনের ভিতরে। এখনও নিশ্চয় শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে। আশেপাশেই কোনখানে।
জুতো ভিজে গেছে। পিচ্ছিল হয়ে গেছে মাটি। নরম কাদায় উঠছে আর পড়ছে পা দুটো। বার বার পিছলে পড়তে পড়তে বাচছি।
কতক্ষণ দৌড়ালাম বলতে পারব না। লেকের মধ্যে পড়তে পড়তে বাঁচলাম। লেকের ধারে পৌঁছে গেছি। বৃষ্টির পানিতে ভরে গেছে। নিচু পাড় ছাপিয়ে উপচে পড়ছে। যে
ঘুরে দাঁড়ালাম। আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে খানিকটা। লেকের আশেপাশেই কোথাও রয়েছে সেই পায়েচলা সরু পথটা, যেটা ধরে বাড়ি থেকে এসেছি।
দুলন্ত গাছের মাঝখানে রাস্তাটা খুঁজে পেতে দেরি হলো না। বনের ভিতর থেকে বেরোতে পারব তো?
চেষ্টা করতে দোষ নেই।
কিছুদূর এগোতেই ধরে এল বৃষ্টি। তবে সর্বনাশ যা করার করে দিয়ে গেছে। এত কাদা, পা ফেললেই মাটিতে বসে যাচ্ছে জুতো। দৌড়ানো অসম্ভব করে তুলেছে।
ঝুঁকে থাকা বুড়ো-মানুষ গাছটার দেখা মিলল অবশেষে।
এই তো পাওয়া গেছে! এই তো পাওয়া গেছে। চেঁচিয়ে উঠলাম। হাত উঁচু করে বাতাসে ঘুসি মারতে লাগলাম আনন্দে। বাড়ির কাছাকাছি প্রায় পৌঁছে গেছি।