টর্চের আলোটা কমে গিয়ে আবার উজ্জ্বল হলো। গোলাকার আলোকরশ্মি আমার আর গাছগুলোর মাঝে একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে যেন। ত। ক্যামেরার কেসটা চোখে পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলাম। চ্যাপ্টা একটা শিকড়ের ওপর রেখেছি ওটা। কিন্তু ক্যামেরা ফেলে রেখে যাওয়ার মত এতবড় একটা ভুল কীভাবে করলাম মাথায় ঢুকছে না। উত্তেজিত হলে কত কী-ই না করে মানুষ!
ছুটে গিয়ে তুলে নিলাম ক্যামেরাটা। ফিরে পেয়ে এত খুশি হয়েছি, মনে হচ্ছে জড়িয়ে ধরে আদর করি। সাবধানে টর্চের আলোয় দেখতে লাগলাম।
ওপরে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়েছে। মুছে ফেললাম। ফিরে চললাম বাড়ির দিকে। টু বৃষ্টি থেমে গেছে আপাতত। মনের আনন্দে গুন গুন করে গান গাইতে লাগলাম। বাড়ি ফেরার তর সইছে না যেন। মনে হচ্ছে এক লাফে রাস্তাটুকু পেরিয়ে বাড়ি চলে যাই। o ক্যামেরাটা আমার কাছে ভীষণ মূল্যবান। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, কখনও আর কোনভাবেই কোথাও ফেলে যাব না এটা।
রাগত একটা শব্দ শুনে গুনগুন থামিয়ে দিলাম।..
গর্জন করে উঠেছে একটা জানোয়ার। গলার গভীর থেকে বেরোচ্ছে চাপা গরগর শব্দ।
হাত থেকে টর্চ খসে পড়ল আমার।
আবার গর্জন করে উঠল জানোয়ারটা।
আমার পিছনে কোথাও!
এগারো
নিচু হয়ে তুলে নিলাম টর্চটা। দুর্বল লাগছে দুই হাঁটু। ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত ছড়িয়ে পড়ল যেন সারা শরীরে।
আবার গর্জন শোনা গেল। রাগত গরগর।
জোর করে সামনে পা বাড়ালাম। এখান থেকে পালাতে হবে আমাকে।
সামনে মাথা তুলে রেখেছে বড় একটা ঝোপ। ক্যামেরাটা শক্ত করে চেপে ধরে দৌড়ে চলে এলাম ঝোপের অন্যপাশে। হাঁটু গেড়ে বসলাম।
ঝোপের আড়ালে বসে হাঁপাচ্ছি। দম ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছি। বুকের মধ্যে বাড়ি মারতে থাকা হৃৎপিণ্ডটার গতি কমাতে চাইছি।
ঝোপের ঘন পাতার জন্য ওপাশে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু জানোয়ারের গরগর শুনতে পাচ্ছি। যতটা সম্ভব নামিয়ে রেখেছি মাথা, যাতে আমাকে না দেখে। তবে আমার গায়ের গন্ধ পেয়ে গেলে আর কিছু করার থাকবে না। খোদা, গন্ধ যেন না পায়-প্রার্থনা করলাম মনে মনে।
মাটিতে ভারি কী যেন আছড়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ চিৎকার। মনে হলো, কোন কিছুর ওপর হামলা চালিয়েছে।
ভয়ার্ত কাতর আর্তনাদ করে উঠল অন্য একটা জানোয়ার। আতঙ্কিত চিৎকারের শব্দটা মাঝপথেই কাটা পড়ে গেল।
কেটে দেয়া হলো আসলে।
ঝোপের আড়ালে ঝুঁকে বসে আছি। পা কাঁপছে। সারা শরীর কাঁপছে। কানে আসছে ধস্তাধস্তির শব্দ।
এত কাছে, মনে হচ্ছে উঠে দাঁড়ালেই হাত বাড়িয়ে হামলাকারী ও তার শিকারকে ছুঁতে পারব।
প্রতিটি গোঙানি, প্রতিটি ভয়ার্ত ককানি কানে আসছে।
ধুপ করে শব্দ হলো। আরেকটা চাপা গর্জন। আরেকটা অসহায় কাঁতরানি।
মাংস ঘেঁড়ার শব্দ।
চিবানোর শব্দ। চোয়াল খটখটানির শব্দ। আরও চিবানো। জানোয়ারের ঢেকুর তোলা। আবারও মাংস ছেঁড়ার শব্দ। ঘটনাগুলো ঘটছে আমার ঠিক সামনেই, ঝোপের ওপাশে।
চোখ বুজলাম। কী ঘটছে, কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। আবারও ধুপ করে শব্দ। তারপর নীরবতা। বাতাসের গতি বাড়ছে।
সামনে হিসিয়ে উঠল কী যেন। তারপর আবার চুপ। চোখ মেলোম। কম্পিত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। এ ভারি পায়ের শব্দ কানে এল। পায়ের চাপে ভাঙছে শুকনো ডাল পাতা।
দ্রুত এগিয়ে আসছে পায়ের শব্দ। আমার দিকে।
আমাকে ধরতে আসছে জানোয়ারটা?
তার নিজেকে সামলাতে পারলাম না। চাপা আতঙ্কিত চিৎকার বেরিয়ে গেল আমার গলা চিরে।
শক্ত হাতে ক্যামেরাটা চেপে ধরে ঘুরে দাঁড়ালাম ঝোপের দিক থেকে। দৌড়ানো শুরু করলাম।T,
আমার পিছনে ভারি হাঁপানোর শব্দ হচ্ছে। ফিরে তাকালাম না।
ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়লাম বনের গভীরে। ডানে পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে। কিংবা পানি বয়ে যাবার। নিশ্চয় উলফ লেক। কিন্তু দেখার জন্য থামলাম না।
পাশ দিয়ে যাবার সময় ডালে ঘষা লাগল আমার গাল। ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল মুখ জুড়ে।
হাত দিয়ে চেপে ধরলাম গাল। দৌড়ানো বন্ধ করলাম না।
অন্ধের মত দৌড়াচ্ছি। অন্ধকারে দৌড়ে চলেছি। টর্চটা কোথায়? মনে পড়েছে। ঝোপের কাছে ফেলে এসেছি।
লম্বা নলখাগড়ার বনে ঢুকলাম। গাছগুলো শপাং শপাং করে বেতের মত বাড়ি মারছে আমার গায়ে। শিশির ও বৃষ্টিতে ভিজে আছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে।
মাটিতে অর্ধেক গেঁথে থাকা একটা পাথরে পা পড়ল আমার। পিছলে গেল পা। বহু কষ্টে সামলে নিয়ে আছাড় খাওয়া থেকে বাঁচলাম।
নলখাগড়ার বন থেকে বেরিয়ে এলাম। লাফিয়ে পেরিয়ে এলাম একটা উঁচু হয়ে থাকা গাছের শিকড়।
জোরে জোরে হাঁপাচ্ছি। সেই শব্দকে ছাপিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম পিছনে পায়ের শব্দ আমাকে অনুসরণ করছে কি না। জানোয়ারের গর্জন শোনা যায় কি না। এ টি
এখনও কি জানোয়ারটা আমাকে তাড়া করছে?
মসৃণ একটা গাছের ডাল ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম। এত বেশি পা কাঁপছে, মনে হচ্ছে খাড়া থাকতে পারব না। প্রায় ঝুলে পড়লাম ডালটা ধরে। স্বাভাবিকভাবে দম নেয়ার চেষ্টা করলাম।
তারপর ফিরে তাকালাম পিছনে।
কিছুই নেই।
গর্জন নেই। ঘোঁতঘোঁতানি নেই। ছুটে আসা ভারি পায়ের শব্দ হচ্ছে না মাটিতে। 1 হাঁপানো থামছে না আমার। কিছুতেই কমাতে পারছি না ঘন ঘন। শ্বাস নেয়া। পুড়ে যাচ্ছে যেন ফুসফুস। মুখের ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ। ঢোক গিলতে পারছি না।