- বইয়ের নামঃ নেকড়ের বনে
- লেখকের নামঃ শামসুদ্দীন নওয়াব
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প, অ্যাডভেঞ্চার
নেকড়ের বনে
এক
উলফ লেক বাস স্টেশনে বাস থেকে নামলাম। কড়া রোদ লাগছে চোখে। কপালে হাত রেখে রোদ আড়াল করে তাকালাম ছোট্ট পার্কিং লটটার দিকে। সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টি এসেছেন কি না দেখছি।
আঙ্কেল-আন্টির চেহারা মনে নেই আমার। শেষ দেখেছি চার বছর বয়েসে। তবে আশা করি এত বছর পরেও ঠিকই চিনতে পারব।
উলফ লেকের বাস স্টেশনটা খুবই ছোট। মস্ত একটা পার্কিং লটের মধ্যে ছোট্ট একটা কাঠের ছাউনি। লোকজনের ভিড় নেই।
কটা সুটকেস? গর্জনের মত শোনাল ড্রাইভারের কণ্ঠ। অক্টোবরের ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ধূসর ইউনিফর্মের বগলের কাছটা ঘামে ভেজা।
একটা, জবাব দিলাম।
বাস স্টেশনের অন্য প্রান্তে, একটা গ্যাস স্টেশন ও একটা ছোট জেনারেল স্টোর। তার ওপাশে বন। ডাল আঁকড়ে থাকা শরতের হলদে-বাদামী পাতাগুলো রোদে চকচক করছে। ঝরে পড়া শুকনো পাতা মৃদু সরসর শব্দ তুলে গড়িয়ে যাচ্ছে পার্কিং লটে।
ঘোঁতঘোঁত করে ঘুরে দাঁড়াল ড্রাইভার। হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেলল। ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্টের দরজা। কালো রঙের একটা সুটকেস টেনে বের করল। এটা?
মাথা ঝাঁকালাম। হ্যাঁ। ধন্যবাদ।
উলফ লেকে একমাত্র আমিই নেমেছি।
ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ে কাঁটা দিল আমার। শীতের পোশাক সুটকেসে ভরে দিয়েছে তো মা
খুব তাড়াহুড়া ছিল মা-বাবার। ভুলে যদি না দিয়ে থাকে তো বিপদেই পড়ব।
আমাদের স্কুলের হ্যালোউইনের ছুটির ঠিক আগে এভাবে জরুরি কাজে ডাক পড়বে ওদের, গ্রীন হিলস ছেড়ে চলে যেতে হবে, ভাবেনি। যাওয়ার আগে অন্তত দুই সপ্তাহ আমার থাকার মত একটা জায়গা ঠিক করে দিতে হয়েছে। দুসপ্তার বেশিও থাকতে হতে পারে আমার, ঠিক নেই। মুসারা সপরিবারে বেড়াতে চলে গেছে। আর কিশোররা রকি বিচ থেকে আসেনি এবার। ওরা এলে আমার থাকার অসুবিধে হত না। যাই হোক, অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষে সিডার আঙ্কেল আর জুলি আন্টিকেই পছন্দ হয়েছে মা-বাবার। সিডার আঙ্কেল আমার দূর সম্পর্কের চাচা।
আমার কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরার ব্যাগটা সোজা করলাম। বাসযাত্রার পুরো সময়টাই ওটা আমার কোলের ওপর রাখা ছিল। ব্যাগেজ কমার্টমেন্টে রাখিনি, ঝাঁকুনিতে গড়াগড়ি খেয়ে নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে।
এই ক্যামেরাটা এখন আমার কাছে সবচেয়ে দামি জিনিস। এটা ছাড়া কোথাও যাই না আমি। এমনকী চোখের আড়াল করতেও রাজি নই।
চত্বরের ওপর দিয়ে সুটকেসটা আমার দিকে ঠেলে দিল ড্রাইভার। দড়াম করে লাগিয়ে দিল ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্টের দরজা। বাসে উঠতে গিয়ে ফিরে তাকাল আমার দিকে। নিতে আসবে কেউ?
আসবে, জবাব দিয়ে আবার তাকালাম সিডার আঙ্কেল আর জুলি আন্টি আসছেন কিনা দেখার জন্য।
কাদায় মাখামাখি নীল রঙের একটা ভ্যানকে চাকার তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে পার্কিং লটের দিকে এগোতে দেখলাম। হর্ন বাজল। প্যাসেঞ্জার সিটের জানালা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা হাত। আমার উদ্দেশে নাড়াচ্ছে কেউ।
ওই যে, এসে গেছে। বাস ড্রাইভারকে বললাম আমি। সাড়া না পেয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখি বাসে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে ও। কেমন হিসহিস শব্দ করল বাসটা, গোঙাল, তারপর চলতে শুরু করল।
অ্যাই, রবিন! ভ্যান থেকে ডাকলেন আমাকে জুলি আন্টি।
আমার সুটকেসটা তুলে নিয়ে প্রায় লাফাতে লাফাতে এগোলাম। ওদের দিকে। আমার কাছে এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল ভ্যানটা। ড্রাইভিং সিট থেকে নামলেন সিডার আঙ্কেল। অন্যপাশে প্যাসেঞ্জার সিট থেকে নেমে দৌড়ে এলেন জুলি আন্টি।
দুজনেই বেশ মোটাতাজা। ওঁদেরকে দেখে অতি পেটুক নেকড়ের চেহারা ভেসে উঠল চোখের সামনে। দুনিয়ায় এত প্রাণী থাকতে কেন যে নেকড়ের কথা ভাবলাম, জানি না।
জুলি আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, রবিন, তোমাকে দেখে কী যে খুশি হয়েছি! তুমি আসাতে খুব ভাল লাগছে!
আমাকে ছেড়ে দ্রুত পিছিয়ে গেলেন তিনি। এহহে, আমি তোমার, ক্যামেরা কেসটা নষ্ট করে দিচ্ছি!
না না, ঠিক আছে, কেসের ফিতে ঘুরিয়ে ক্যামেরাটা অন্যপাশে সরাতে সরাতে জবাব দিলাম, এত নরম না যে নষ্ট হবে।
হাসিমুখে আমার সঙ্গে হাত মেলালেন সিডার আঙ্কেল, তারপর পিঠে চাপড় দিলেন। বাতাসে উড়ছে তাঁর কোঁকড়া কালো লম্বা চুল।
বয়েসের তুলনায় অনেক বড় হয়ে গেছ, আমার আপাদমস্তক দেখলেন তিনি। তা বাসে আসতে কেমন লাগল?
প্রচুর ঝাঁকুনি, জবাব দিলাম। একটা গর্তও তো বাদ দেয়নি ড্রাইভার, সবগুলোতে চাকা ফেলেছে। আর আমার পাশের ভদ্রলোক সারাক্ষণ হিক্কা তুলেছেন, একনাগাড়ে।
জুলি আন্টি হাসলেন। বাহ্, বেশ মজার যাত্রাই তো!
আমার ক্যামেরা কেসের দিকে চোখ নামালেন সিডার আঙ্কেল। মনে হচ্ছে ছবি তুলতে খুব পছন্দ করো?
মাথা ঝাঁকালাম। হ্যাঁ। বড় হয়ে ফটোগ্রাফার হবার ইচ্ছে আছে আমার। আপনাদের দুজনের মত। তিনি
হাসি চওড়া হলো ওঁদের। খুশি হয়েছেন মনে হলো।
কিন্তু দ্রুত মলিন হয়ে গেল সিডার আঙ্কেলের হাসি। খুব কঠিন পেশা। প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে হয়, দূর-দূরান্তে যেতে হয়। এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারি না আমরা।