কু! কু! কু! সতর্ক করল রানী আর টিটো। ঘুরে দাঁড়াল তিন বন্ধু।
উঠে পড়েছে বাঘটা। একদৃষ্টে ওদের দিকে চেয়ে। চোখজোড়া ধক-ধক করে জ্বলছে।
পাগলের মত চারধারে নজর বুলাল কিশোর। পালাবে কোথায়?
বাঘটা গর্জে উঠল ওদের উদ্দেশে।
এবার ধীর পায়ে, নিঃশব্দে এগিয়ে আসতে লাগল।
আট
বিশাল বাঘটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে তিন বন্ধুর দিকে ক্রমেই কাছিয়ে
আসতে লাগল।
হাততালি দিল কিশোর।
আমরা শান্তি চাই! চেঁচিয়ে উঠল।
কিন্তু বাঘটা এগিয়েই আসছে। চোখ জ্বলছে। ঠোঁট কুঁকড়ে গেছে।
হুফ! হুফ! রবিনের উদ্দেশে ক্রুদ্ধ ডাক ছাড়ল বাঘা।
বাঘা পালাতে বলছে! বলল রবিন।
কিশোরের হাত চেপে ধরে তীরের দিকে টানল।
মুসা, এসো! জরুরী কণ্ঠে বলল।
দাঁড়াও, বাঘার কী হবে? চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
চিন্তা কোরো না! বলল রবিন।
কালো পাথরটার আড়ালে কিশোরকে টেনে নিয়ে গেল ও।
বাঘা তো মারা পড়বে, বলল মুসা।
ওর কিচ্ছু হবে না-আমি জানি! বলল রবিন।
বাঘার ডাক এখন তীব্র গর্জনে রূপ নিয়েছে।
হুফ! হুফ! গররর! গররর!
বাঘার হুঙ্কার ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।
শুনে তো বাঘার গলা মনে হচ্ছে না, বলল কিশোর।
এবার হঠাই নীরবতা নেমে এল। আশ্চর্য এক নৈঃশব্দ্য।
বাঘা? ডাকল রবিন। এতক্ষণে ওকে উদ্বিগ্ন মনে হলো।
মাথা তুলল নথি। পাথরের উপর দিয়ে উঁকি দিল তিন বন্ধু।
ঘাসের উপরে পরম সাহসিকতায় দাঁড়িয়ে বাঘা।
বাঘটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যাচ্ছে। একটু পরে গাছ-পালার আড়ালে উধাও হয়ে গেল।
গোটা বনভূমি যেন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল-শেষমেশ নীরবতা ভঙ্গ করল রবিন।
তোর তুলনা নেই, বাঘা, বলল ও।
লাঙ্গুর দুটো হাততালি দিয়ে লাফাতে লাগল।
হুফ! হুফ! আবারও যেন খুদে কুকুর হয়ে গেল বাঘা। লেজ নেড়ে দৌড়ে এল তিন বন্ধুর কাছে।
ওকে কোলে তুলে নিল রবিন।
তুই আমাদের জীবন বাঁচিয়েছিস,বলল ও।
বাঘটাকে খেদালি কীভাবে? বাঘার মাথা ঘষে দিয়ে প্রশ্ন করল মুসা। তুই কি বুনো কুকুর হয়ে গেছিলি নাকি?
বাঘা হাঁপাচ্ছে। ওদের হাত চেটে দিল।
কিশোর বনভূমির দিকে চাইল।
ট্রীহাউসটা কোথায় আল্লাই জানে, বলল ও। রানী আর টিটো কিশোরের উদ্দেশে কিচকিচ করে কী সব বলল। এবার বাহু নেড়ে, দৌড় দিল তীর ধরে।
ওরা ওদেরকে ফলো করতে বলছে, বলল রবিন। এসো।
পাথর থেকে জিনিসপত্র তুলে নিল ওরা। এবার তীর ধরে বানর দুটোর পিছু নিল।
সকালের আলোয় কাঁপছে পানি। শূন্যে লাফ দিচ্ছে রুপোলী মাছ।
রানী আর টিটোর সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে বাঘা। শীঘ্রি ওরা একটা বাকের আড়ালে হারিয়ে গেল।
ওদেরকে অনুগমন করল তিন বন্ধু। বাঁক ঘুরতেই দেখতে পেল বুদ্ধাসনে বসে রয়েছে এক লোক। লাঙ্গুর দুটো তার কাছে বসা।
লোকটির দুচোখ বোজা। মুখে সাদা দাড়ি-গোঁফ। গায়ের রং বাদামী। মুখের চেহারায় প্রশান্তির ছাপ।
নয়
রানী আর টিটো মানুষটার চুল সমান করে দিল নিজেদের থাবা দিয়ে। গালে হাত বুলাল।
লোকটি মৃদু হেসে ফিসফিস করে ওদের সঙ্গে কথা বলল। চোখ। বন্ধ।
বাঘা লোকটির কাছে গিয়ে তার দুহাত চেটে দিল।
এখনও চোখ খোলেনি লোকটি। তবে বাঘার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করল।
নক, নক, মৃদু কণ্ঠে বলল রবিন।
কেউ আছে এখানে? লোকটি প্রশ্ন করল।
মুখ ফেরাল তিন বন্ধুর উদ্দেশে। এখন চোখ ভোলা, তবে ওদেরকে দেখতে পাচ্ছে বলে মনে হলো না। মানুষটি অন্ধ, উপলব্ধি করল কিশোর।
হাই, আমি রবিন।
আমি কিশোর।
আমি মুসা।
মৃদু হাসল অন্ধ মানুষটি।
ভাল, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল। তোমরা আমার কাছে এসেছ?
হ্যাঁ, জানাল কিশোর।
তিন বন্ধু লোকটির দুপাশে বসল।
আপনি জঙ্গলে থাকেন? রবিনের প্রশ্ন।
হ্যাঁ।
আপনি কি সন্ন্যাসী? কিশোর জানতে চাইল।
হ্যাঁ। একা থাকি বলে প্রকৃতি থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি।
কীভাবে শেখেন? প্রশ্ন করল মুসা।
কান পাতলেই শোনা যায়, শেখা যায়।
কান পেতে কী শোনেন আপনি? জানতে চাইল কিশোর।
বানরদের কিচিরমিচির, হাতির ডাক, বাঘের গর্জন, বল লোকটি। এতদিন ধরে শুনছি যে মনে হয় সব মিলেমিশে বনদের একটা মাত্র কণ্ঠ হয়ে গেছে।
কণ্ঠটা কি আপনাকে বলেছে কালকে রাতে একটা বাঘ ফাঁদে পড়েছিল? প্রশ্ন করল রবিন।
হ্যাঁ, বলল সন্ন্যাসী।
সে কি এ-ও বলেছে, আমরা ওকে বাঁচানোর পর ও আমাদেরকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মৃদু হাসল অন্ধ মানুষটি।
নদী থেকে আমাকে একটা জলপদ্ম এনে দাও, বলল সে।
কিশোর বুঝে পেল না হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টাল কেন সন্ন্যাসী।
কিন্তু রবিন তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছুটে গেল নদীতে। বড় দেখে একটা ফুল ছিঁড়ে নিল ও। কাদাটে শিকড়সুদ্ধ উঠে এসেছে ওটা। অন্ধ মানুষটির কাছে ফুলটা নিয়ে গেল ও।
ধন্যবাদ, জানাল লোকটি।
ফুলটার পাপড়ি আর কাদামাখা শিকড় স্পর্শ করল।
ময়লা, ঘন কাদায় ভাল জলপদ্ম ফোটে, বলল সে। এর সৌন্দর্যের সঙ্গে এর কুৎসিত দিকটাও মিশে রয়েছে। বুঝতে পেরেছ।
হ্যাঁ, বলল তিন বন্ধু।
তোরা যখন বাঘটাকে বাঁচিয়েছ তখন তার সম্পূর্ণ অস্তিত্বকেই বাঁচিয়েছ, বলল অন্ধ মানুষটি। তোমরা ওর অপরূপ সৌন্দর্য আর ভয়ঙ্কর রূপ দুটোকেই বাঁচিয়েছ। একটা ছাড়া অন্যটাকে কল্পনা করা যায় না।
হ্যাঁ…ঠিক বলেছেন, বলল কিশোর।
তোমরা এই জলপদ্মটাকে এ জঙ্গলের পক্ষ থেকে গ্রহণ করো। তোমরা যেহেতু আমাদের ভয়ঙ্কর বন্ধুকে রক্ষা করেছ, বলল অন্ধ মানুষটি। ওকে ছাড়া আমাদের দুনিয়া অসম্পূর্ণ।