ঝোপ মাড়িয়ে ছুটে গেল বাঘটা।
তিন বন্ধু দোল খেয়ে উঠে গেল লাঙ্গুরদের গাছে।
কিশোর একটা পা বাধিয়ে চেপে ধরল গাছের গুঁড়ি। লতাটা ছেড়ে দিয়ে আঁকড়ে ধরল একটা ডাল।
বাপরে বাপ! বলল ও। চমকিত।
লাঙ্গুর দুটো ওর পিঠ চাপড়ে সাবাস দিল যেন।
দারুণ মজা লেগেছে, বড় এক ডালে বসে বলল রবিন।
মজা? পাগল নাকি তুমি? বলল অপর এক ডালে বসা মুসা।
দোল খেতে ভাল লেগেছে, বলল রবিন। তবে বাঘটাকে দেখে ভয় পেয়েছি।
এসময় গাছটা দুলতে শুরু করল। নুয়ে পড়েছে ডাল।
খাইছে!
বাঘেরা কি গাছে চড়তে পারে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
সম্ভবত, বলল কিশোর। গুঁড়িটা জড়িয়ে ধরে চোখ বুজল।
নীচে থেকে চিবানোর আর ভাঙচুরের জোরাল শব্দ ভেসে এল।
গর্জে উঠল বাঘা।
গোঙানির শব্দ বেরোল কিশোরের গলা দিয়ে।
বাঘ গাছটাকে খেয়ে ফেলছে, বলল মুসা। ৯ হেসে ফেলল রবিন।
হুপ-হুপ শব্দ করল রানী আর টিটো। কথাটা শুনে ওরাও যেনজা পেয়ে হাসছে।
হুফ! হুফ! ডাক ছাড়ল বাঘা।
কী হলো! বলল মুসা। চোখ বুজে ফেলেছিল।
দেখো! বলল রবিন।
একটা শুঁড়। হাতির।
শুঁড়টা ওদের শোঁকার জন্য কিলবিলিয়ে উঠল যেন। এবার গাছ থেকে পাতা নিয়ে সরে গেল।
চলল, দেখি কী ব্যাপার! বলল রবিন।
বাঘা তখনও প্যাকের ভিতরে, রবিনকে অনুসরণ করে নিচু এক। ডালে নেমে এল কিশোর আর মুসা।
প্রায়ান্ধকার জঙ্গলের দিকে চোখ সরু করে চাইল ওরা। ছায়া-ছায়া অন্ধকারে এক পাল হাতি দেখতে পেল।
একটা হাতি দাঁড়িয়ে ওদের গাছের নীচে, পাতা খাচ্ছে। অন্যগুলো ঘাস চিবোচ্ছে।
অ্যাই, দারুণ একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে আমার, হঠাৎই বলল রবিন।
পাঁচ
কী সেটা? প্রশ্ন করল কিশোর।
বাঘটাকে কীভাবে এড়াতে হবে জানি আমি, বলল রবিন। আমাদের বইটাতে আছে না বাঘ হাতিদের ঘাঁটায় না?
আছে তো, বলল কিশোর।
কাজেই আমরা হাতির পিঠে চেপে জঙ্গল পার হব, বলল রবিন।
কিশোর ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল।
বুদ্ধিটা ভাল। কিন্তু—
কোন কিন্তু নয়। আমি আগে চড়ব, বলল রবিন।
আরও খানিকদূর নেমে হাতির পিঠের কাছাকাছি হলো ও। একটা ডাল থেকে সাবধানে পা নামাল। ওর পা হাতিটার পিঠ স্পর্শ করলে, ডালটা ছেড়ে দিল। এবার ধীরে সুস্থে বসে পড়ল।
হাতিটা মৃদু গুড় গুড় শব্দ করে ভর বদল করল।
ভয় পাস না, আমি তোর কোন ক্ষতি করব না, মোলায়েম স্বরে বলল রবিন। বিশালদেহী জানোয়ারটার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল।
ধন্যবাদ, মায়া।
মায়া? প্রশ্ন করল মুসা।
হ্যাঁ, এটাই ওর নাম। এইমাত্র আমাকে বলেছে, বলল রবিন।
হুঁ, বলল মুসা।
হুফ! হুফ! এসো তোমরা, ভয়ের কিছু নেই, ডাকল রবিন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর। ডাল থেকে দোল খেল ও আর মুসা। মায়ার উপরে ঝুলছে, এসময় ডাল থেকে নিজেদেরকে নামিয়ে আনল ওরা।
দু’পা হাতিটার উপর রেখে সাবধানে রবিনের সামনে বসল কিশোর। মুসা বসল পিছনে।
আবারও গুড়-গুড় করে উঠল মায়া।
ওকে বলো ভয় না পেতে, বলল রবিন। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।
ভয় পাসনে, মায়া, বলল কিশোর। হাতিটার মাথা চাপড়ে দিল। জানোয়ারটার চামড়া কর্কশ আর কুঁচকানো।
হাতিটা শুঁড় কুঁকড়ে পিছনে এনে কিশোরের মাথায় রাখল।
হাই, কিশোর বলল মৃদু কণ্ঠে।
কান ঝাঁপটাল মায়া।
রানী আর টিটো মায়ার সামনে দোল খেয়ে নেমে এল। কিচিরমিচির করে কী সব যেন বলল হাতিটাকে। মায়া ওদের উদ্দেশে শুড় নাড়ল। লাঙ্গুর দুটো জঙ্গল ভেদ করে লাফাতে লাফাতে ছুটল।
ওদেরকে অনুসরণ করল মায়া।
পালের বাদবাকিরা এক সারে অনুসরণ করল ওকে। গদাইলশকরী চালে চলেছে মায়া। মুসার মনে হলো মহাসাগরের ঢেউয়ের উপর চড়ে ভেসে যাচ্ছে বুঝি।
গাছ-গাছালির উপরে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।
কোথায় যাচ্ছি আমরা? মুসার প্রশ্ন।
চিন্তা কোরো না, বলল রবিন। রানী আর টিটো জানে কোথায় যেতে হবে।
হুফ! হুফ! বাঘা ডাক ছাড়ল কিশোরের ব্যাকপ্যাক থেকে।
তুইও নিশ্চিন্ত থাক, ছোট কুকুরটাকে আশ্বস্ত করল কিশোর।
জোনাকী জ্বলছে। চাঁদ গাছ-পালা ভেদ করে আলোকিত করে। রেখেছে পথ। হাতির পাল ধীরেসুস্থে চলেছে।
এসময় দূরাগত নিচু এক গর্জন শোনা গেল।
বাঘটা নাকি? ভাবল কিশোর।
হাতির দল শব্দটাকে পাত্তা দিল না। উষ্ণ বনভূমি ভেদ করে হেঁটে চলেছে ওরা। ঝুলে পড়া লতা-পাতার নীচ দিয়ে, আর ধোঁয়াটে ফাঁকা জমি ভেদ করে হেলেদুলে চলেছে পালটা।
রানী আর টিটো লাফাতে লাফাতে আগে আগে চলেছে। দুটো ছায়া তিন বন্ধুকে পথ দেখাচ্ছে।
আমরা ট্রীহাউস থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি, বলল কিশোর।
ভয় পেয়ো না, বলল রবিন।
হঠাই, দীর্ঘ এক গর্জন চিরে দিল রাতের নিস্তব্ধতা।
শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল কিশোরের।
হুঙ্কারটা শোনা গেল আবারও। শেষমেশ ওটা রূপ নিল। গোঙানিতে। গোটা বনভূমি যেন কাতরাচ্ছে।
মনে হচ্ছে খুব কষ্ট পাচ্ছে, বলল মুসা।
হ্যাঁ, বলল কিশোর।
কিন্তু হাতির পাল এগিয়েই চলল।
ঢুলুনি মত এসে গেল কিশোরের। ব্যাকপ্যাকে নাক ডাকছে বাঘার।
শীঘ্রি কিশোরের মাথা আশ্রয় নিল মায়ার পিঠে। একটু পরেই ভাঙা-ভাঙা স্বপ্ন দেখতে লাগল ও।
ছয়
ক্যক!
অক! অক! অক!
ধীরে ধীরে স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল কিশোর। চমকে চোখ মেলল ও।
আবছা সূর্যের আলো ঘিরে রেখেছে ওকে।
আমি কোথায়? আতঙ্কিত কিশোর ভাবল।
এবার মনে পড়ল-ভারতে, এক হাতির পিঠে!
উঠে বসল ও। কুয়াশা ভেদ করে দেখতে পেল কর্দমাক্ত এক নদীর তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মায়া।