মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার সেভারন। বাপের ওপর অভিমান করে মেয়ে কোন খাবারই স্পর্শ করল না; না খেয়ে খেয়ে মারা গেল।
এই ঘরের মধ্যে! আঁতকে উঠল মুসা। চারপাশে তাকাতে লাগল এমন ভঙ্গিতে, যেন এখনই ভূতটা বেরিয়ে এসে ঘাড়ে চাপবে ওর।
না, এখানে না, অন্য আরেকটা ঘরে; বহু আগেই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে ওটা। দুর্গে আগুন লেগেছিল। তবে, এ ঘরে না মরলেও, ওদের দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে হেসে বললেন মিস্টার সেভারন, এখানে রাতের বেলা চুরি করে জোয়ালিনের সঙ্গে দেখা করতে আসত যুবক।
খাইছে! মুসার ভঙ্গি দেখে মনে হলো সময় থাকতে উঠে চলে যাবে। কিনা ভাবছে।
জোয়ালিনের আর কোন ভাই-বোন ছিল না। তার মৃত্যুর পর খুব বেশিদিন আর বাঁচেনি তার বাবা-মা। পুরো পরিবারটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। লোকে বলে, জোয়ালিন এখনও তার প্রেমিকের অপেক্ষায় আছে। রাতের বেলা নাকি বেরিয়ে পড়ে তারই খোঁজে।
গল্প শেষ হওয়ার পরে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
ঘোরের মধ্যে থেকে যেন বলে উঠল রবিন, বেচারি!
কি সব মানুষ! বিরক্ত হয়ে বলল মুসা, খাবার নিয়ে আবার কেউ গোসসা করে নাকি? মরার যেন আর কোন উপায় খুঁজে পেল না!
না খেয়েই নাহয় মরল, মিস্টার সেভারন বললেন, কিন্তু তাতেই কি ভূত হয়ে যেতে হবে নাকি? আসলে এ রকম ইমোশনাল গল্প ভালবাসে লোকে, সেজন্যেই তৈরি করে।
তবে, কিশোর বলল, মিসেস সেভারন যদি রাতের বেলা কিছু দেখেই থাকেন, তার কোন একটা বাস্তব ব্যাখ্যা নিশ্চয় রয়েছে।
রবিন বলল, আপনাদের কেউ ভয় দেখাতে চেয়েছে।
চট করে পরস্পরের চোখের দিকে দৃষ্টি চলে গেল বুড়ো-বুড়ির, কিশোরের চোখ এড়াল না সেটা।
এস্টেট থেকে আসা পোলাপানগুলো হতে পারে, মিস্টার সেভারন বললেন। ওদেরকে এদিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি আমি। নিশ্চয় ভূতের গুজবটা ওরা শুনেছে। রাতে ভয় দেখাতে এসেছে আমাদের।
মেঝেতে পড়ে থাকা একটা বই তুলে নিল কিশোর। মলাট ওল্টাল। সাদা পাতাটায় পেঁচানো অক্ষরে লেখা রয়েছে একটা নাম-জ্যাকুয়েল সেভারন। চিঠির ঠিকানার হাতের লেখা আর এই লেখার সঙ্গে মিল রয়েছে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলল, তারমানে ওরা ভাল ছেলে না। ভাল হলে রাতের বেলা অন্যের বাড়িতে ঢুকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করত না। ওরা আরও খারাপ কিছু করতে পারে। চুরিদারি, কিংবা যা খুশি। সাবধান থাকতে হবে আপনাদের। জানালায়ও তালা লাগাতে হবে। পুরানো আমলে তৈরি এ সব জানালা সহজেই বাইরে থেকে খুলে ফেলা যায়।
হ্যাঁ, কিশোরের সঙ্গে একমত হলেন মিস্টার সেভারন।
ঘর দেখা হয়েছে। সারি বেধে বেরোনোর সময় জিজ্ঞেস করল কিশোর, গুজবটা কি সবাই জানে নাকি এদিকের?।
জানে, মাথা আঁকালেন মিস্টার সেভারন। আগের মালিক তো তার বাড়িতে যে ভূত আছে এটা নিয়ে গর্বই করত। আমরা বাড়িটা কেনার আগে জ্যাকি যখন দেখতে এসেছিল, সব বলেছিল তাকে জারভিস। জ্যাকি গিয়ে সবখানে গপ মেরে ছড়িয়েছে, তার বাবা একটা ভূতুড়ে বাড়ি কিনতে যাচ্ছে। বলেছে হয়তো মজা করার জন্যেই, কিন্তু…।
এই সময় বাড়ির বাইরে থেকে ডাক দিল কে যেন। জানালার পর্দা সরাতে দেখা গেল ডাক পিয়ন। দরজার নিচ দিয়ে কয়েকটা চিঠি ঠেলে দিয়ে চলে গেল সে।
তুলে নিলেন মিস্টার সেভারন। ঠিকানাগুলো পড়তে লাগলেন। উদ্বিগ্ন মনে হলো তাকে।
কৌতূহলী হয়ে গলা বাড়িয়ে দিল কিশোর। একটা চিঠিতে দেখল সেই একই রকম লোগো। এস আর এইচ অক্ষর দুটো একটার সঙ্গে আরেকটা পেঁচিয়ে লিখে তৈরি করা হয়েছে লোগোটা।
ওদের চিঠিও আছে?
কাদের চিঠি, নামটা ইচ্ছে করেই যেন চেপে গেলেন মিসেস সেভারন।
মিস্টার সেভারনও একই রকম চেপে যাওয়া ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, হ্যাঁ।
চিঠিগুলো হলের টেবিলে রেখে দিলেন তিনি।
ও আমাদের ছাড়বে না! বিড়বিড় করে বললেন মিসেস সেভারন।
.
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তিন গোয়েন্দাকে বিদায় জানালেন দুজনে।
রাস্তা দিয়ে কয়েকশো গজ এসে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। সাইকেল থেকে নেমে সাইকেলটা ঠেস দিয়ে রাখল একটা দেয়ালে। দুই সহকারীকে জিজ্ঞেস করল, তারপর? কে কি সূত্র পেলে?
আমি পেয়েছি, রাগত স্বরে বলল মুসা, একটা খুনীকে! বনের মধ্যে। আরেকটু হলেই ফুটো করে দিয়েছিল আমাকে। পকেট থেকে কার্তুজের ন্টখোসা দুটো বের করল মুসা। এই দেখো। তুলে নিলাম যখন, তখনও গরম ছিল।
একটা খোসা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল কিশোর, একটু অন্য রকম।
মানে? কিশোরের হাত থেকে খোসাটা নিয়ে রবিনও দেখতে লাগল।
চাচা একবার একটা পুরানো বন্দুক কিনে এনেছিল, কয়েক বাক্স পুরানো গুলি সহ, কিশোর বলল। গুলিগুলো এ রকম ছিল। চাচা বলেছে, ঘরে বানানো গুলি ছিল ওগুলো।
কিশোরের হাতে খোসাটা ফিরিয়ে দিল রবিন। এ রকম গুলি কখনও দেখিনি আমি। কোন মন্তব্য করতে পারব না।
আমিও দেখিনি,মুসা বলল।
হু, ওর দিকে তাকাল কিশোর। একটা লোক ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইল, দুটো গুলির খোসা পেলে; এ ছাড়া আর কিছু?
মাথা নাড়ল মুসা। না। লোকটার চেহারা দেখতে পারলে ভাল হত। পাতার জন্যে ওপরটা দেখা যাচ্ছিল না। কাছে এসে যখন দাঁড়াল, চোখে পড়ল শুধু গাঢ় রঙের জ্যাকেটের নিচের অংশ। জিনসের প্যান্ট ছিল পরনে। পায়ে বুট। আর দশজন সাধারণ মানুষের মত।