দরজা খুললেন মিসেস। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগল গোয়েন্দাদের গায়ে। শীতের বাতাসের মত।
খাইছে! চমকে গেল মুসা। কিশোরের হাত খামচে ধরল।
হাতটা ছাড়িয়ে নিল কিশোর। ভয় পাচ্ছ?
নীরবে মাথা নাড়ল মুসা।
এ ঘরে আসতে আমার ভাল লাগে না, কেঁপে উঠলেন মিসেস সেভারন। গায়ে কাঁটা দিল মনে হলো। জ্যাকি চলে যাওয়ার পর এটাকে সেলাইয়ের ঘর বানিয়েছিলাম আমি। কিন্তু এমন ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা, হাড়ের মধ্যে ব্যথা শুরু হয়ে যায় আমার।
সাবধানে ঘরে পা রাখল তিন গোয়েন্দা। কেঁপে উঠল কিশোর। তার টি শার্ট আর সুতির প্যান্ট ঠাণ্ডা ঠেকাতে পারছে না। বাইরে কড়া রোদ থাকা সত্ত্বেও ঘরটার মধ্যে ডিসেম্বরের বিকেলের মত ঠাণ্ডা।
বাপরে! সত্যি ঠাণ্ডা! রবিন বলল।
রোদ লাগে না কোন দিক দিয়ে, মিস্টার সেভারন বললেন। ঘরের মধ্যে নেই কোন ধরনের হীটিং সিসটেম। শীতকালে যে আর্দ্রতা ঢেকে, সেটা আর বেরোতে পারে না। সারা বছর সেঁতসেঁতে হয়ে থাকে। গরম হবে। কোত্থেকে।
আগুন জ্বেলেও গরম করার চেষ্টা করে দেখেছি, মিসেস বললেন। কাজ হয়নি। যে ঠাণ্ডা সেই ঠাণ্ডা।
নিচে একটা পুরানো সেলার আছে, মিস্টার সেভারন বললেন। সেটাতে আছে চিমনি। সেই চিমনি দিয়ে নিচের ঠাণ্ডা ওপরে উঠে আসে।
আগের মালিক কিছু জিনিসপত্র ফেলে গেছেন, হাত তুলে দেখালেন মিসেস সেভারন। ওই যে কার্পেটটা, ওটা ছিল তাদের। নতুন বাড়ি করে চলে গেছেন, তাতে এ জিনিস মানাবে না-বেশি পুরানো আমলের, তাই ফেলে গেছেন। আর ওই বুকশেলফটাও…
কিশোর দেখল, মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে আছে কতগুলো বই। দেয়াল থেকে খুলে পড়েছে একটা ছবি। কেউ ফেলে দিয়েছে মনে হচ্ছে। পুরানো কার্পেটটা মেঝের বেশির ভাগ অংশই ঢেকে রেখেছে, জায়গায় জায়গায় দুমড়ানো। টেনে সোজা করে দেয়ার জন্যে নিচু হলো সে।
অবাক কাণ্ড! কিশোরকে দোমড়ানো জায়গাগুলো সমান করতে দেখে মিসেস সেভারন বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম, ওটা, পেরেক দিয়ে লাগানো। সোজা হবে না। কুঁচকালও, সোজাও হচ্ছে আবার।
মেঝেতে পড়ে থাকা জিনিসগুলো তুলে সেলাইয়ের জিনিসপত্র রাখার বাক্সে রাখল রবিন। কিশোরকে সাহায্য করার জন্যে কার্পেটের একদিক ধরে টান দিল। নড়ল না। মেঝের তক্তার সঙ্গে আটকানো রয়েছে এদিকটা। বাক্সটা দিল মিসেস সেভানের হাতে।
গির্জায় যারা বিয়ে করতে আসে, তাদের পোশাক বানাতাম আমি, মিসেস সেভারন বললেন। এখন আর পারি না। কাজ করতে গেলেই আঙুল কেমন আঁকড়ে আসে।
আশ্চর্য! ঘরের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে বলল কিশোর। দেয়ালের কাঠের রঙ গাঢ় বাদামী। চেহারাটা কেমন বিষণ করে দিয়েছে ঘরটার। দেখলে অবশ্য ভূতুড়েই মনে হয়।
তুমি বলছ এ কথা! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।
ভূতুড়ে লাগলেই যে ভূত থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই।
ভূতুড়ের মানে কি তাহলে?
জবাব দিল না কিশোর।
জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন মিস্টার সেভারন। মিসেস দলে ভারী হয়ে যাচ্ছেন দেখে যেন হতাশ হয়েছেন।
আপনি বিশ্বাস করেন না এ সব? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, মাথা নাড়লেন মিস্টার সেভারন।
মেঝেতে জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়ল কি করে? কেউ তো নিশ্চয় ফেলেছে।
তার হয়ে জবাবটা দিয়ে দিল রবিন, ভূমিকম্পেও পড়তে পারে। ক্যালিফোর্নিয়ায় তো আর ভূমিকম্পের অভাব হয় না, যখন তখন কেপে ওঠে মাটি।
তাহলে বাকি ঘরগুলোর জিনিস মাটিতে পড়ল না কেন? প্রশ্ন করলেন মিসেস সেভারন।
শুকনো হাসি হাসলেন মিস্টার সেভারন। বিশ্বাসই যখন করো, আসল কথাটাই বলে দাও ওদের।
আসল কথা? ভুরু কুঁচকাল কিশোর। জোয়ালিন।
জোয়ালিন!
পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা। মিস্টার সেভারনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, জোয়ালিনটা কে?
এক এক করে তিনজনের দিকে তাকালেন মিস্টার সেভারন। লম্বা দম ছাড়লেন। তারপর বললেন, ভূত!
.
০৫.
আবার দৃষ্টি বিনিময় করল গোয়েন্দারা।
মুসা ভাবছে, সত্যি সত্যি তাহলে বাড়িটাতে ভূতের উপদ্রব আছে! একটা মেয়ের ভূত রাত দুপুরে সত্যি ঘুরে বেড়ায় বাড়িময়।
ওদের দিকে তাকিয়ে কোনমতে মুখে হাসি ফোঁটালেন মিসেস সেভারন। তারপর ফিরলেন স্বামীর দিকে। গল্পটা শুনিয়েই দাও না ওদের।
চেয়ারে হেলান দিলেন মিস্টার সেভারন। এই কটেজটা এক সময় অনেক বড় ছিল। আঠারোশো শতকে তৈরি করা একটা দুর্গের অংশ এটা। এই ঘরটা ছিল বিশাল ডাইনিং রূমের অংশ। মালিক ছিল ওয়ারনার নামে এক ধনী লোক। ওদের একমাত্র মেয়ে জোয়ালিন। অপূর্ব সুন্দরী। জন্মেছিল নববর্ষের দিনে। মা-বাবার চোখের মণি।
ভূতে ধরল কি করে তাকে? ফিসফিস করে বলল মুসা। ভয়ও পাচ্ছে, কৌতূহলও দমন করতে পারছে না।
শোনোই না! রবিন বলল।
এক জিপসি যুবকের প্রেমে পড়েছিল সে, মিস্টার সেভারন বললেন।
চেপে রাখা দুমটা আস্তে করে ছাড়ল রবিন। বাহ বেশ রোমান্টিক তো!
গুঙিয়ে উঠল মুসা। রোমান্টিক দেখলে কোথায়? এ তো ডবল ভূতের আলামত!
মিস্টার সেভারন বললেন, তার বাবার ধারণা ছিল, ওদের টাকা-পয়সা দেখেই মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে যুবক। ওসবের লোভে। তা ছাড়া সামান্য এক জিপসি যুবককেও পছন্দ করতে পারছিল না সে। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়েও মেয়েকে ফেরাতে না পেরে শেষে ঘরে তালা দিয়ে রাখল।
সেই পুরানো কাহিনী! কিড়বিড় করল কিশোর। বড়লোক বাপ তার মেয়েকে কোনমতেই এক ছন্নছাড়ার হাতে তুলে দিতে চায় না। অতএব দুর্ঘটনা! তাই তো?