ঝোপের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইল দুজনে। বুকের মধ্যে টিপ টিপ করছে মুসার হৃৎপিণ্ডটা। ভয় হতে লাগল, সেই শব্দও শুনে ফেলবে লোকটা। ঝোপঝাড় ভেঙে কে যেন এগিয়ে আসতে লাগল।
ওদের ঝোপটার কাছে এসে দাঁড়াল একজোড়া বুট। পা ফাঁক করে দাঁড়াল। পায়ের সামনে তেরছা ভাবে এসে পড়েছে সূর্যরশ্মি। পকেট থেকে আরও দুটো কার্তুজ বের করে বন্দুকে ভরল সে। ধীরে ধীরে বন্দুক তুলে। নিশানা করল ওদের দিকে।
.
০৪.
দম আটকে ফেলল মুসা। চারপাশটা বড় বেশি নীরব। পাতার ফাঁক দিয়ে তাকাল আবার লোকটার দিকে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। খুজছে কাউকে।
একটা পাথর তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল মুসা। গাছের গায়ে লেগে ঝোপের মধ্যে গড়িয়ে পড়ল পাথরটা।
আবার ঝোপঝাড় ভেঙে সেদিকে ছুটল লোকটা। কাঁটাঝোপে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। চাপা গোঙানি শোনা গেল। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে আবার দিল দৌড়।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মিস্টার সেভারনকে হাত ধরে টেনে তুলল মুসা। যে পথে এসেছিল, তাঁকে নিয়ে সেই পথটা ধরে ছুটল কটেজের দিকে। ঝোপের ধারে দুটো কার্তুজের খোসা পড়ে থাকতে দেখে কুড়িয়ে নিল। এখনও গরম। পরে ভাল করে দেখবে ভেবে ঢুকিয়ে রাখল জিনসের পকেটে।
মিস্টার সেভারন, পুলিশকে জানানো দরকার এখনই। ওই লোকটা পাগল।
মুসাকে অবাক করে দিয়ে মাথা নাড়লেন মিস্টার সেভারন। না। আমি পুলিশের কাছে যাব না।
কিন্তু আরেকটু হলেই আমাদের খুন করে ফেলেছিল! ঘোড়ায় চড়ে আসাটা তো এখানে বিপজ্জনক। গুলির শব্দে ভয় পেয়ে গেলে পিঠ থেকে সওয়ারী উল্টে ফেলে পালানোর চেষ্টা করবে ঘোড়া। মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাবে। লোকটা ভীষণ বিপজ্জনক।
তার পরেও পুলিশের কাছে যেতে রাজি হলেন না মিস্টার সেভারন। জ্যাকেটে লেগে থাকা শুকনো পাতা ঝেড়ে ফেলে বললেন, লোকটা চলে গেছে এতক্ষণে। আমার ধারণা, ভুল করেছে সে। হরিণ-টরিণ বা ভালুক ভেবে আমাদের গুলি করেছে।
তাহলেও মস্ত অপরাধ করেছে সে, কারণ এখানে শিকার করা বেআইনী। তার ভুলের জন্যে মারাত্মক জখম হতে পারতাম আমরা। এ ভাবে যেখানে সেখানে গুলি চালানোর জন্যে তো আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয় না। পুলিশকে না জানালে এখন সেটা আমাদের অপরাধ বলে গণ্য হবে।
বন থেকে বেরিয়ে দেখল ওদের দিকে দৌড়ে আসছে রবিন।
কি হয়েছে? দূর থেকেই চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল সে। গুলির শব্দ শুনলাম।
একটা উন্মাদ আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিল, জবাব দিল মুসা।
কেন? কাছে চলে এসেছে রবিন।
ভুল করেছে, মুসাকে কথা বলতে দিলেন না মিস্টার সেভারন। শটগান থেকে গুলি ছোঁড়ার প্র্যাকটিস করছিল বোধহয়। দুই আঙুলে টিপে ধরে কাপড় থেকে আরেকটা পাতা তুলে ফেলে দিলেন তিনি। কোন ক্ষতি হয়নি আমাদের।
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মুসা। ঘটনাটাকে দুর্ঘটনা বলে চালাতে চাইছেন মিস্টার সেভারন।
ছড়িতে ভর দিয়ে দিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন তিনি।
রবিনের হাত চেপে ধরল মুসা, রবিন, একটা লোক সত্যি সত্যি আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছিল।
তোমাকে নয় নিশ্চয়; ভয়টা আসলে দেখাতে চেয়েছে মিস্টার সেভারনকে, চিন্তিত ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। এমনিতেই তো যথেষ্ট ভয়ের মধ্যে আছেন তাঁরা, আর কত?
সব শুনে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল মিসেস সেভারনের।
আরও যে কত কি ঘটবে খোদাই জানে! দুই হাতে মাথা চেপে ধরলেন। তিনি। কাল রাতে এ রকম একটা ব্যাপার…তারপর এখন এই! টিকতে দেবে না।
কাল রাতে কি হয়েছিল? জানতে চাইল মুসা।
ভূতের উপদ্রব আছে যে ঘরটায়, জবাব দিল কিশোর, সেটাতে নাকি অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়েছেন মিসেস সেভারন।
ভয়ানক শব্দ! মিসেস সেভারন বললেন। মনে হলো নাকি স্বরে কাঁদছে কেউ, তারপর আবার খিলখিল করে হাসছে। ইনিয়ে বিনিয়ে কি সব বলছে।
জিনিসপত্রও নাকি তছনছ করেছে, কিশোর বলল।
ছায়ামূর্তিটার কথা বাদ দিচ্ছ কেন? রবিন বলল।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে অধৈর্য কণ্ঠে বললেন মিস্টার সেভারন, তারমানে বলে দিয়েছ ওদের! এ সব অতি কল্পনা…
না, কল্পনা নয়, রেগে উঠলেন মিসেস সেভারন, আমি দেখেছি ওটাকে! কোন ভুল ছিল না। ফিনফিনে পোশাক পরা কুয়াশার মত একটা ধূসর মূর্তি হালকা পায়ে ছুটে গেল লনের ওপর দিয়ে।
বোঝানোর চেষ্টা করলেন মিস্টার সেভারন, দেখো, কুয়াশার মধ্যে চাঁদের আলোয় অদ্ভুত সব আকৃতি তৈরি হয়, বাতাসে কুয়াশা উড়ে বেড়ানোর সময় মনে হয় মানুষ হাটছে…
জোরে জোরে মাথা নেড়ে মিসেস সেভারন বললেন, না, আমি যা দেখেছি ঠিকই দেখেছি। চাঁদের আলোয় কুয়াশায় কি হয় না হয় জানা আছে। আমার।
স্বামী-স্ত্রীর তর্কটা বন্ধ করার জন্যে কিশোর বলল, ঘরটা আমাদের দেখাবেন বলেছিলেন?
তা তো দেখাবই। নিশ্চয় দেখাব, মিসেস বললেন। তোমরা গোয়েন্দা। দেখো, কিছু বুঝতে পারো নাকি।
ওদের নিয়ে চললেন তিনি। ভূতুড়ে ঘরটা রয়েছে বাড়ির পেছন দিকে, রান্নাঘরের পরে।
বাড়ির সবচেয়ে পুরানো অংশ এটা, সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন মিস্টার সেভারন। স্থানীয় একজন মিস্ত্রি বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, মিস্টার জারভিস যখন থাকতেন। আমাদের আগের মালিক মিস্টার জারভিস, তাঁর কাছ থেকেই বাড়িটা কিনেছি। পেছনের এই দিকটা তেমন ব্যবহার করি না আমরা। জ্যাকি এ ঘরটাকে তার স্টাডি বানিয়েছিল। এখানকার জিনিসপত্র বেশির ভাগই তার। কিন্তু… থেমে গেলেন তিনি। তারপর বললেন, ভূত নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না তার।