ছবিটা আবার মাউন্টে ঢোকাতে গিয়ে ছবির নিচে প্রিন্ট করা তারিখটা চোখে পড়ল ওর। গত বছরের তারিখ : ১০ আগস্ট।
ঘরে ঢুকল কিশোর।
ছবি রেখে তার কাছে সরে এল রবিন।
মুসা কি দেখেছে, রবিনকে জানাল কিশোর।
সাবধান করে দিলে না ওকে? দূরবীনধারী লোকটার কথা শুনে চিন্তিত হলো রবিন।
করেছি।
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। পর্দা ফাঁক করে তাকাল। মাঠের কিনারে পৌঁছে গেছে মুসা আর মিস্টার সেভারন। নিচু হয়ে একটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে নিয়ে দাতে কাটল মুসা। হাত নেড়ে তৃণভূমির অন্যপ্রান্তে কি যেন তাকে দেখাতে চাইছেন মিস্টার সেভারন।
গলাটাকে বকের মত পাশে লম্বা করে দিয়েও কিছু দেখতে পেল না কিশোর। বাইরে না গেলে দেখা যাবে না। হতাশ ভঙ্গিতে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সে।
ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলেন মিসেস সেভারন। তাঁকে সাহায্য করতে উঠে গেল রবিন।
আগের দিনের সোফাটায় বসল কিশোর। এক কাপ চা এগিয়ে দিল রবিন। কফি টেবিলটায় সেটা রাখতে গিয়ে গোটা তিনেক চিঠি চোখে পড়ল কিশোরের। একটাতে সেই বিচিত্র লোগো ছাপ মারা। বাকি দুটোতে ডাক বিভাগের সীল দেখে বোঝা যায় লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে এসেছে। ঠিকানায় মিসেস সেভারনের নাম। পেঁচানো হাতের লেখা।
হাত বাড়িয়ে একটা চিঠি তুলে নিতে গিয়েও থেমে গেল কিশোর। ন্টঅন্যের চিঠি দেখা ঠিক না। মিসেস সেভারন কিছু মনে করতে পারেন।
চায়ের কাপে চুমুক দিল সে। মুখ তুলে তাকাল বৃদ্ধার দিকে। কাল রাতে নাকি কি ঘটেছে, মিসেস সেভারন?
হ্যাঁ
শোনার জন্যে মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর। বলুন না, শুনি।
.
লম্বা ঘাস মাড়িয়ে তখন বনের কাছে পৌঁছে গেছে মুসা আর মিস্টার সেভারন। ঢুকে পড়ল বনের মধ্যে। রাস্তাটা দেখতে পেল মুসা। পুরানো ওকের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গিয়ে বেরিয়েছে একটা খোলা জায়গায়। পায়ের নিচে কার্পেটের মত বিছিয়ে আছে ঝরা পাতা।
কাটতে না কাটতে রাস্তায় উঠে আসে কাঁটালতা, দুদিনও যায় না, মিস্টার সেভারন বললেন। ছাত্ররাই কেটে কেটে পরিষ্কার করে রাখে।
কোন ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থেকে কুহু-কুহু করে উঠছে একটা কোকিল। ওটার মিষ্টি স্বরের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন কর্কশ স্বরে প্রতিবাদ জানাচ্ছে ওকের ডালে বসা একটা দাঁড়কাক।
মিস্টার সেভারন জানালেন বহু শত বছর ধরে আছে এখানে বনটা।
দারুণ জায়গা! ঘোড়া নিয়ে সত্যি আসতে পারব তো? কোন অসুবিধে হবে না?
না, হবে না। যখন খুশি চলে এসো।
অদ্ভুত এই বনটার ভেতর দিয়ে ঘোড়া ছোটাতে কেমন লাগবে ভাবতেও রোমাঞ্চিত হলো মুসা।
মিস্টার সেভারন বলে চলেছেন, এই এলাকার সবচেয়ে পুরানো বন এটা। লোকে এখনও বেড়াতে এসে মজা পায় এখানে। তবে কদ্দিন পাবে আর জানি না। যে হারে কাটাকাটি শুরু হয়েছে…আমি যখন যুবক ছিলাম, তখনও অনেক বড় ছিল ওই বন। মাঠের ওপাশটাতেও ঘন বন ছিল। সব তো কেটে সাফ করেছে।
ওই যে নতুন স্পোর্টস সেন্টার আর শপিং সেন্টার খুলেছে ওটার কথা বলছেন?
হ্যাঁ, বিষণ্ণ হয়ে গেল মিস্টার সেভারনের দৃষ্টি। আর কিছুদিন পর খোলা জায়গা বলতে কিছু থাকবে না। সব বাড়িঘর দিয়ে ভরে ফেলবে।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা সরু রাস্তা চোখে পড়ছে। তাতে একটা সাদা রঙের ভ্যানগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মুসা।
কার গাড়ি? মিস্টার সেভারনও দেখেছেন। এ রকম জায়গায় তো গাড়ি পার্ক করে না কেউ।
একটু আগে একটা লোককে দেখেছি আমি। দূরবীন দিয়ে আপনাদের বাড়ির ওপর চোখ রাখছিল।
থমকে দাঁড়ালেন মিস্টার সেভারন। কি বলছ! চলো চলো, ফিরে যাই। মিসেস সেভারনকে একা ফেলে এসেছি!
তার উদ্বেগ দেখে অবাক হলো মুসা। একা কোথায়? কিশোর আর রবিন আছে। কেউ কিছু করতে পারবে না তার।
মুসার কথা শেষও হলো না, বনের মধ্যে গুলির শব্দ হলো। লাফিয়ে উঠল মুসা। এত কাছে কে গুলি করছে? শব্দ লক্ষ করে সে ঘুরতেই দেখতে পেল লোকটাকে। চোখের পলকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ছায়ার মত।
এখানে কি শিকারের অনুমতি আছে? জানতে চাইল সে।
মাথা নাড়লেন মিস্টার সেভারন। ভুরু কোচকালেন। না। কে গুলি ছুড়ছে বুঝতে পারছি না। ওই ভ্যানে করেই এসেছে মনে হচ্ছে। ভ্যানের ছাতে চড়ে বেড়া ডিঙানো সম্ভব।
আবার গুলির শব্দ। হাই ভেলোসিটি শটগান থেকে ছোঁড়া হচ্ছে। অতিরিক্ত কাছে।
ভয় লাগছে মুসার। এখানে থাকাটা নিরাপদ মনে হচ্ছে না আমার। কোন্ সময় এসে গায়ে লাগে!
গাছের ফাঁকে আবার ছায়ামূর্তিটাকে চোখে পড়ল মুসার। কাঁটাঝোপের কাছে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। হাতের বন্দুকের নল এদিকে ফেরানো।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধে বন্দুকের বাঁট ঠেকিয়ে নিশানা করল লোকটা।
মিস্টার সেভারনের হাত ধরে টান দিল মুসা, চলুন। লোকটার ভাবসাব সুবিধের লাগছে না আমার।
তৃতীয়বার গুলির শব্দ হলো। ওদের মাথার ওপরের ডালে ছরছর করে এসে লাগল ছররা। ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল দুজনে।
পাখি তো কই, উড়ছে না, ফিসফিস করে বলল মুসা। আমাদেরকেই নিশানা করছে না তো?
হাতটা ধরে রেখেই বুঝতে পারছে সে, মিস্টার সেভারন কাঁপতে শুরু করেছেন। মাথা নেড়ে কম্পিত গলায় বললেন, মনে হয় না!
চুপ করে থাকুন। তাহলে ও মনে করবে আমরা চলে গেছি। হয়তো আর গুলি করবে না।