সরে এল মুসা। পেছন দিক দিয়ে গিয়ে দেখি আছে নাকি।
কিন্তু পেছনে এসেও কাউকে দেখতে পেল না সে। কয়লার বাঙ্কারের ওপর গলা বাড়িয়ে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। খালি। বাগানের ছাউনির পাশ ঘুরে এসে দাঁড়াল সাদা রঙ করা সুন্দর একটা ভিকটোরিয়ান সামার-হাউসের সামনে। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাল। কয়েকটা সাধারণ টুকিটাকি জিনিস ছাড়া মেঝেতে বিছানো রয়েছে পোকায় কাটা একটা পুরানো কার্পেট, দুটো ধুলো পড়া পুরানো ডেকচেয়ার, আর আপেল রাখার কয়েকটা কাঠের বাক্স। বাক্সগুলো খালি। বহু বছর এখানে কেউ ঢুকেছে বলে মনে হলো না।
বাগানের শিশিরে ভেজা ঘাস মাড়িয়ে হেঁটে গেল সে। বেড়ার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। তাকিয়ে রইল একপাশের সবুজ তৃণভূমির দিকে। রঙবেরঙের প্রজাপতি আর বড় বড় ভোমরা উড়ে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে। বাটারকাপ, অক্স-আই ডেইজির ছড়াছড়ি। আর রয়েছে লম্বা, ব্রোঞ্জ রঙের এক ধরনের বুনো গুল্ম। দারুণ জায়গা! ফায়ারকে এনে ছেড়ে দিলে মন মত চরে খেতে পারবে।
হঠাৎ একটা ঝিলিক দেখতে পেল মাঠের কিনারের বনের মধ্যে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সে। কিসের আলো? টর্চ? মনে হয় না। বাচ্চারা হয়তো খেলা করছে। কোন ধাতব জিনিস বা কাঁচে প্রতিফলিত হয়েছে রোদ।
ভাবনাটা মাথা থেকে দূর করে দেবার আগেই গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। গলায় ঝোলানো জিনিসটা দূর থেকেও চিনতে পারল মুসা। দূরবীন।
একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল। বোধহয় মুসাকে দেখল। তারপর আবার চলে গেল গাছের আড়ালে। দূরবীনের কাঁচে লেগে ঝিক করে উঠল রোদ।
কে লোকটা? কটেজের ওপর চোখ রাখছিল কেন? ভাবতে ভাবতে কটেজের পাশ ঘুরে সামনের দিকে এগোল মুসা।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন মিস্টার সেভারন। মুসাকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন, অ্যাই, ছেলে, কে তুমি?
ও মুসা, মিস্টার সেভারন, তাড়াতাড়ি পরিচয় দিল কিশোর। আমাদের সঙ্গেই এসেছে। সামনের দরজায় সাড়া না পেয়ে পেছন দিক দিয়ে দেখতে গিয়েছিল।
ও, তুমিই মুসা। ধূসর চুলে আঙুল চালালেন তিনি। তিনজনেই এসেছ জানতাম না…
হেসে হাত বাড়িয়ে দিল মুসা। মিস্টার সেভরনের হাতটা ধরে রেখে চোখের ইশারায় চারপাশটা দেখিয়ে বলল, খুব সুন্দর জায়গা। ঘোড়দৌড়ের প্র্যাকটিস করার জন্যে এরচেয়ে ভাল আর হয় না।
মুসার হাতটা ছেড়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার সেভারন। হ্যাঁ। তবে ওখানে যেতে হলে, তৃণভূমিটা দেখিয়ে বললেন, আমার জায়গার ওপর দিয়ে ছাড়া যেতে পারবে না। ঘোড়া চলাচলের একটা রাস্তা আছে বনের ভেতর দিয়ে। রাইডিং স্কুলের ছেলেরা মাঝে মাঝেই আসে এখানে ঘোড়ায় চড়া প্র্যাকটিস করতে। মুসার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন তিনি, ঘোড়ায় চড়তে ভাল লাগে মনে হয় তোমার?
মাথা ঝাঁকাল মুসা, লাগে। আমার নিজেরই একটা ঘোড়া আছে।
তাহলে তো ভালই। প্র্যাকটিস করতে ইচ্ছে হলে চলে এসো যে কোন সময়। আগাম অনুমতি দিয়ে রাখলাম।
থ্যাংকিউ, মিস্টার সেভারন।
চলো, রাস্তাটা দেখিয়ে আনি তোমাকে।…দাঁড়াও, এক মিনিট, আমার ছড়িটা নিয়ে আসি।…কিশোর, রবিন, তোমরা ঘরে গিয়ে বসো, আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলো। কথা বলার মানুষ পেলে খুশি হবে ও, তোমাদের মত শ্রোতা পেলে। …কাল রাতের ঘটনাটা খুব রসিয়ে রসিয়ে বলতে পারবে।
কাল রাতে আবার কি ঘটল আগ্রহী হয়ে উঠল কিশোর।
সেটা তার কাছেই শুনো।
ছড়ি নিতে ঘরে ঢুকলেন মিস্টার সেভারন।
মুসার সঙ্গে বাগানের দিকে কিছুদূর এগিয়ে গেল কিশোর। সামার হাউসটা দেখে বলল, বাহ, খুব সুন্দর ভো। কাছে গিয়ে জানালা দিয়ে ভেতরে। তাকাল। কিন্তু কেউ থাকে বলে তো মনে হয় না।
কথাটা যেন মুসার কানেই গেল না। কিশোরের বাহু চেপে ধরল, কিশোর, একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
কি?
বনের মধ্যে একটা লোক…
মানে?
কটেজের ওপর চোখ রাখছিল।
ভ্রূকুটি করল কিশোর। তুমি শিওর?
হ্যাঁ। গলায় ঝোলানো একটা দূরবীন। আমাকে দেখেই লুকিয়ে পড়ল। সন্দেহ হলো সেজন্যেই।
কেমন দেখতে?
মাথা নাড়ল মুসা, মুখ দেখিনি। লোকটা বেশ লম্বা। মাথায় চওড়া কানাওয়ালা নরম হ্যাট। ওর কাজকারবার মোটেও ভাল লাগেনি আমার।
নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর। হু! হাঁটতে গেলে এখন সাবধান থাকবে। বুঝতে পারছি না, সেভারনদের বাড়ির ওপর নজর রাখতে যাবে কে! তবে যদি রেখে থাকে, কোন কারণ নিশ্চয় আছে। তারমানে সেভারনদের যারা বন্ধু, তারা লোকটার শত্রু। আমাদের জন্যে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। চোখকান খোলা রেখো।…ওই যে, মিস্টার সেভারন বেরিয়েছেন। তোমরা। যাও। আমি আর রবিন মিসেস সেভারনের সঙ্গে কথা বলিগে। শুনি, কাল রাতে কি ঘটেছে।
.
০৩.
কটেজের সামনের ঘরে রবিনকে বসতে দিলেন মিসেস সেভারন।
চাটা আমিই বানিয়ে নিয়ে আসি, মিসেস সেভারন, প্রস্তাব দিল রবিন।
রাজি হলেন না মিসেস সেভারন, না, আমিই পারব। অত দুর্বল ভেবো না। আমাকে। তোমরা আরাম করে বসো।
রান্নাঘরে চলে গেলেন তিনি।
কিন্তু বসে থাকতে ভাল লাগল না রবিনের। উঠে ম্যানটলপীসের দিকে এগিয়ে গেল জ্যাকি সেভারনের ছবিটা দেখার জন্যে। পর্দা টানা থাকায় ঘরে আলো কম। ভাল করে দেখার জন্যে নামিয়ে আনতে গেল। কাত হয়ে কার্ডবোর্ডের মাউন্ট থেকে খসে পড়ে গেল ওটা। তাড়াতাড়ি তুলে নিল আবার। আড়চোখে রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল মিসেস সেভারন দেখে ফেললেন কিনা।