পারতেই হবে, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। না পারলে চলবে না!
কানফাটা শব্দ তুলে পার হয়ে গেল ট্রেন খুলে যেতে শুরু করল গেট। প্যাডালে চাপ দিল ওরা। লাইন পেরিয়ে আসতেই পেছন থেকে শোনা গেল গাড়ির হর্ন। সামান্য ভাঙা ভাঙা। পরিচিত মনে হলো কিশোরের। ফিরে তাকাতেই দুলে উঠল বুক। ইয়ার্ডের পিকআপটা। গাড়ি চালাচ্ছেন রাশেদ পাশা। পাশে বসে আছে ডন।
হাত তুলল কিশোর।
আগেই দেখতে পেয়েছেন রাশেদ পাশা। রাস্তার পাশে থামালেন।
পিকআপের পেছনে মুসাকে দেখে অবাক হলো কিশোর। কিন্তু প্রশ্ন করার সময় নেই এখন। গাড়ি থামতেই পাশে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিল মুসা, সাইকেলগুলো দাও, তুলে ফেলি।
সাইকেল দুটো তুলে রবিন আর কিশোরের উঠে বসতে মিনিটখানেকও লাগল না। পাশ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল কিশোর, চাচা, যাও। ওল্ড প্যাসিফিক স্ট্রীটের মাথায় আমাদের নামিয়ে দিলেই চলবে।
গাড়ি চলল। মুসার দিকে তাকাল কিশোর, তুমি চাচাকে পেলে কোথায়?
কাকতালীয় ঘটনা প্রচুর ঘটে পৃথিবীতে, কৃত্রিম গাম্ভীর্য দেখিয়ে দার্শনিকের ভঙ্গিতে জবাব দিল মুসা। চাকা ফুটো হওয়াতে হাজারটা গাল দিয়েছি সাইকেলটাকে। ঠেলে নিয়ে প্রায় পৌঁছে গেছি সেভারনদের বাড়ির গেটে, এই সময় পাশের আরেকটা রাস্তা থেকে বেরিয়ে পেছন থেকে আমার পাশে এসে দাঁড়াল পিকআপটা। ডন আমাকে সাইকেল ঠেলে নিয়ে যেতে দেখে রাশেদ আঙ্কেলকে বলেছে। আমার সাহায্য লাগতে পারে ভেবে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। তোমরা কোথায় গেছ তাঁকে জানালাম। ওল্ড প্যাসিফিক স্ট্রীটে দিয়ে আসতে অনুরোধ করলাম।
হু, একেই বলে ভাগ্য, মাথা দোলাল কিশোর। ম্যানিলা রোডের এক বাড়িতে মালের দরদাম করতে যাওয়ার কথা ছিল চাচার। তোমার চাকাটা ফুটো হলো বলেই দেখাটা হলো, নইলে এখন গাড়িটা পেতাম না।
মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে… কিশোরের কাছ থেকে শেখা বাংলা কবিতাটা এই সুযোগে ঝেড়ে দিল রবিন।
যে ঝরঝরে পিকআপটা নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ আর হাসাহাসি কিশোরও করে, চাচাকে মিউজিয়ামে দিয়ে আসতে বলে, সেটাই এখন বিরাট উপকার করল। সাইকেলের চেয়ে অনেক দ্রুত পৌঁছে দিল ওল্ড স্ট্রীটের মাথায়।
চিৎকার করে চাচাকে বলল কিশোর, রাখো এখানেই।
তিন গোয়েন্দা নেমে গেলে জিজ্ঞেস করলেন রাশেদ পাশা, দাঁড়াব এখানে?
না, লাগবে না, কিশোর বলল, চলে যাও। সাইকেলগুলো নিয়ে যাও। মিস্টার সেভারনকে পেলে তাঁর গাড়িতেই ফিরতে পারবে ম্যানিলা রোডে। সাইকেলগুলো রাখলে ঝামেলা হবে তখন, তাই দিয়ে দিল।
নতুন কোন কেস নাকি তোদের?
হ্যাঁ। পরে বলব সব। যদি সফল হতে পারি কাগজেও দেখতে পাবে।
ডন নামতে চাইল। নামতে দিলেন না রাশেদ পাশা। মুখটাকে পেঁচা বানিয়ে বসে রইল সে। কিশোর ওর দিকে তাকাতেই জিভ বের করে ভেঙচি কাটল। হেসে ফেলল কিশোর। মুসা আর রবিনও হাসতে লাগল।
পিকআপটা, চলতে শুরু করার আগেই রওনা হয়ে গেল তিনজনে। ঢুকে পড়ল কানাগলিটায়, যেটাতে রয়েছে শাজিন-হ্যারিসনের অফিস।
পুরানো বিল্ডিংটার সামনে সেভারনদের সবুজ গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
থামল কিশোর। বলল, গাড়িটা আছে, তারমানে মিস্টার সেভারন এখনও শাজিনের অফিসেই রয়েছেন।
কি করে জানলে? মুসার প্রশ্ন।
তা ছাড়া আর কোথায় থাকবেন? চল, ঢুকে পড়ি।
কিন্তু ঢুকতে গিয়ে হতাশ হতে হলো। বিল্ডিঙে ঢোকার মূল দরজাটা বন্ধ। ঠেলা দিয়ে দেখল রবিন। নব ধরে মোচড় দিল। ভেতর থেকে তালা লাগানো।
তালা দেয়া! কিশোরের দিকে তাকাল সে, কি করা যায়?
আর কোন পথ নেই?
না। কিন্তু মিস্টার সেভারন ঢুকলেন কিভাবে?
কি করে বলব? পাল্লায় কাঁধ লাগিয়ে ধাক্কা দিতে শুরু করল কিশোর। হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়ল, নাহ, খোলা যাবে না। শনিবারে কি কেউ কাজ করে না নাকি এখানে? রবিনের দিকে তাকাল আবার সে, ঢোকার আর কোন পথই কি নেই?
এক মুহূর্ত ভাবল রবিন, আছে, তবে দস্যু সাইমন টেম্পলার হওয়া লাগবে আমাদের।
মানে?
একটা ফায়ার এসকে আছে। ওটা বেয়ে উঠতে পারলে…
রবিনকে কথা শেষ করতে দিল না মুসা। দেখাও ওটা, সাইমন টেম্পলারই হব আজ। কোনদিকে?
বাড়ির পাশ দিয়ে দৌড় দিল রবিন। পেছনে চলল মুসা আর কিশোর।
ফায়ার এসকেপটার নিচে দাঁড়িয়ে ওপর দিকে তাকাল কিশোর। চিন্তিত। বিড়বিড় করে বলল, কিন্তু ওটা বেয়ে ওঠা…সত্যি সত্যি সাইমন টেম্পলারকে দরকার…আমরা কি পারব!
তোমাদের দুজনের পারা লাগবে না, নির্দ্বিধায় বলে দিল মুসা, আমি উঠে যাচ্ছি। জানালা দিয়ে ঢুকে নেমে এসে সামনের দরজা খুলে দেব।…রবিন, বলো তো, কোন কোন দিক দিয়ে গিয়ে কিভাবে আসতে হবে?
নড়বড়ে, মরচে পড়া লোহার ধাপগুলো বেয়ে উঠে যেতে লাগল মুসা। কোনভাবে যদি পা পিছলায়, কিংবা কোন একটা ধাপ বসে যায়, নিচে পড়ে যে ছাতু হয়ে যেতে হবে জানে, সেজন্যেই ভয়ে নিচের দিকে তাকাচ্ছে না।
সাবধান, মুসা! ধাপগুলোর গোঙানি আর কচমচ শব্দ বুকের মধ্যে বাড়ি মারছে যেন কিশোরের। অসুবিধে হলে নেমে এসো, অন্য উপায় বের করব।
কিন্তু জানালার কাছাকাছি চলে গেছে ততক্ষণে মুসা। পাশে হাত বাড়িয়ে একটা জানালার চৌকাঠের নিচটা ধরে ফেলল। স্কুলে পড়ল একহাতের ওপর। দ্বিতীয় হাতটাও বাড়িয়ে দিয়ে ধরে ফেলল। নিজেকে টেনে তুলল চৌকাঠের ওপর। ঢুকে গেল ভেতরে। গলা বের করে নিচের দিকে তাকিয়ে হাসল। হাত নেড়ে সামনের দরজার কাছে চলে যেতে ইশারা করল কিশোর আর রবিনকে।