দেখতে দেখতে যন্ত্রটা এত কাছে চলে এল, ওটার বনেটের মরচেগুলোও দেখতে পাচ্ছে ওরা। চোখ বন্ধ করে ফেলল কিশোর। কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়ল না। হাতের চাপ বাড়াল দুই বন্ধুর হাতে। ওরাও চাপ দিল একাত্মতা ঘোষণা করে।
বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। আচমকা নীরবতা নেমে এল রাস্তা জুড়ে। চোখ মেলে দেখল কিশোর, ক্যাব থেকে নেমে আসছে ড্রাইভার। চোখমুখ ভয়ঙ্কর করে এগিয়ে এল ওদের দিকে।
সরো! রবিনের হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে সরানোর চেষ্টা করল সে। মরতে চাও নাকি?
দেখুন, অনুরোধের সুরে বলল কিশোর, আমাদের কথা বিশ্বাস করুন, পুরো ব্যাপারটাই ধাপ্পাবাজি। নইলে কি আর এভাবে মেশিনের সামনে দাঁড়াতাম আমরা আমাদের প্রাণের ভয় নেই?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না!
ইতিমধ্যে হই-হট্টগোল শুনে কি হয়েছে দেখার জন্যে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে সেভারনদের পড়শীরা।
শোনার পর একজন বলল, ঠিকই তো বলছে ছেলেগুলো। আপনি জোর করে ভাঙতে এসেছেন কেন? কে হুকুম দিল আপনাকে?
দ্বিধায় পড়ে গেছে ড্রাইভার। বলল, কাউন্সিল। আমার বস্ ডেকে বলল, ওপর থেকে ভাঙার নির্দেশ এসেছে। আমাকে পাঠাল ভাঙতে।
ভাঙতে বললে ভাঙুন, আমরা তো মানা করছি না, কিশোর বলল। কিন্তু বলছি একটু সময় দিতে, যাতে আমরা প্রমাণ করে দিতে পারি আপনারা ভুল করছেন।
হাতঘড়ি দেখল ড্রাইভার। আমি পারব না। এখান থেকে সেরে গিয়ে আরেকটা কাজ করতে হবে। সময় নেই।
তাহলে ওখানের কাজটাই আগে সেরে আসুন না?
মাথা নাড়ল লোকটা, সরি। এটাই আগে করার হুকুম দিয়েছে।
প্লীজ! অনুরোধ করল রবিন, আধঘণ্টা সময় দিন। তাতেই হয়ে যাবে।
হেলমেটটা খুলে মাথা চুলকাল ড্রাইভার। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। বেশ, দিলাম আধঘণ্টা, যাও। ততক্ষণে চা-নাস্তা খেয়ে নিই আমি। সকালে খবরের কাগজটাতেও চোখ বোলানো হয়নি। মনে থাকে যেন, আধঘণ্টা। তারপর আর সময় পাবে না…
আবার ক্যাবে উঠে গেল সে। লাঞ্চবক্স আর ফ্লাস্ক বের করল।
একটা মুহূর্ত আর দেরি করল না কিশোর। দুই সহকারীকে আসতে বলে ছুটল।
দরজার সামনেই বসে আছেন মিসেস সেভারন। ফ্যাকাসে চেহারা। গায়ের কাঁপুনি যায়নি।
কি বলল ও? জানতে চাইলেন তিনি।
ওরা নাকি রাস্তা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে, কিশোর বলল, আপনাদের বাগানের সামনের অংশটা যাবে।
ঝট করে হাত উঠে গেল মিসেস সেভারনের হাঁ হয়ে যাওয়া মুখে।
ভাববেন না, তাড়াতাড়ি তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল কিশোর, আমরা জানি, এগুলো সব অগাস্ট শাজিনের শয়তানি। প্রমাণ জোগাড় করতে যাচ্ছি আমরা।
কিন্তু…
পরে বলব সব, এখন সময় নেই। আপনাকে শুধু বলে যাচ্ছি, চিন্তা করবেন না। এই, এসো তোমরা।
সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল ওরা। সাঁ সাঁ করে ছুটল। আধঘণ্টা সময়ও নেই হাতে। এর মধ্যে ওল্ড প্যাসিফিক স্ট্রীটে শাজিনের অফিসে যেতে হবে, প্রমাণ জোগাড় করে ফিরতে হবে আবার ম্যানিলা রোডে। অসম্ভব মনে হচ্ছে।
কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ খেয়াল করল কিশোর, রবিন নেই ওদের সঙ্গে। ফিরে চেয়ে দেখল অনেক পেছনে পড়েছে সে। তাড়াতাড়ি আসার জন্যে হাত নেড়ে ইশারা করে আবার সামনে তাকাল কিশোর।
পারব না! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মুসা, কোনমতেই পারব না এই সময়ের মধ্যে।
ফুস্ করে শব্দ হলো। কেঁপে উঠল মুসার হাত। হ্যান্ডেলটা বেয়াড়াপনা শুরু করল। সামনের চাকাটা রাস্তা থেকে নেমে গেল পথের পাশে। সামলাতে পারল না মুসা। উল্টে পড়ে গেল।
ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর আর রবিন।
লাফ দিয়ে নেমে মুসার দিকে দৌড় দিল কিশোর, মুসা! কি হলো তোমার? ব্যথা পেয়েছ?
কনুই ডলল মুসা। উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে টান দিয়ে তুলল সাইকেলটা। সামনের চাকাটার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল এমন করে যেন নিমফুল মুখে দিয়েছে, গেছে!
কি? জানতে চাইল কিশোর।
পাংচার।
ঘড়ি দেখল রবিন, করবটা কি এখন?
তোমরা চলে যাও, মুসা বলল। আমি ফিরে গিয়ে মিসেস সেভারনকে পাহারা দিই।…যাও যাও, দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট কোরো না। দুজনকে ঠেলা দিল সে। নাকি তোমাদের একজন থাকবে, আমি যাব?
মাথা নাড়ল কিশোর, না, তুমিই থাকো। আমরা যাই।
আবার সাইকেলে চাপল দুজনে। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে মুসাকে বলল কিশোর, আমাদের দেরি হলে লোকটাকে ঠেকাবে, যে ভাবে পারো।
দুজনকে চলে যেতে দেখল মুসা। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল। চাকা বসে যাওয়া সাইকেলটাকে ঠেলে নিয়ে চলল কটেজের দিকে।
.
তীব্র গতিতে প্যাড়াল করে চলেছে কিশোর আর রবিন। বেপরোয়া। রাস্তার মোড়গুলোতেও গতি কমাচ্ছে না, জোড়গুলোতেও না। রেলওয়ে ক্রসিঙের দিকে চলেছে এখন।
গেটের দিকে এগোতে এগোতে দমে গেল। লাল আলোটা জ্বলছে নিভছে। ওয়ার্নিং বেল বাজছে। দূরে শোনা গেল ট্রেনের হুইসেল। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করল গেটটা।
বন্ধ হওয়ার আগে পেরোতে পারব? রবিনের প্রশ্ন।
না, ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। চেষ্টা করে লাভ হবে না। আমরা ন্টট্রেনে কাটা পড়ে মরলে কোন উপকার হবে না সেভারনদের।
ট্রেনটা চলে যাওয়ার অপেক্ষায় রইল দুজনে। অস্থির হয়ে বার বার ঘড়ি দেখছে রবিন।
কয়েক যুগ তো পার হয়ে গেল, গজগজ করতে লাগল সে, ট্রেন আসারও আর সময় পেল না! মুসা ঠিকই বলেছে, আধঘণ্টার মধ্যে কোনমতেই ফিরতে পারব না আমরা।