কোথায় নেমেছে? বলে হাটু মুড়ে ওটার সামনে বসে পড়ল রবিন। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে ঝুঁকে তাকাল নিচের দিকে। মেঝে আর ট্র্যাপ-ডোরের মাঝের ফাঁকে আঙুল ঢোকানোর চেষ্টা করল। না পেরে বলল, কিছু একটা দরকার। চাড় মেরে তুলতে হবে।
ও, ভুলে গিয়েছিলাম, মুসা বলল, কটেজের মধ্যে কথার আওয়াজও শুনেছি। হয় টিভি চালানো হয়েছে, নয়তো কথা বলেছেন সেভারনরাই। বেশি ভেতরের দিকে রয়েছেন, নিজেদের মধ্যে আলাপে ব্যস্ত, সেজন্যেই আমাদের ডাক শুনতে পাননি।
কিংবা হয়তো ইচ্ছে করেই খুলছেন না কোন কারণে।
ঘরের চারদিকে তাকাচ্ছে কিশোর। একটা বাক্সের নিচে ডাল ছাঁটার পুরানো মরচে পড়া বড় একটা কাচি দেখে বের করে নিল সেটা। রবিনের পাশে গিয়ে বসল চাড় মেরে ট্র্যাপ-ডোরটা তুলতে ওকে সাহায্য করার জন্যে।
নড়ে উঠল ডোরটা। চাপ বহাল রেখে বলল কিশোর, উঠে যাবে। চাপ ছেড়ো না। আরও জোরে।
ক্যাঁচকোঁচ করে উঠল কজা। বিচিত্র শব্দে গোঙাল পাল্লাটা। হঠাৎ ওপরে উঠে গেল। চিত হয়ে পড়ে গেল কিশোর।
হেসে উঠল মুসা।
কিশোরও হাসল। উঠে বসে কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়তে লাগল।
রবিন কাশছে। গর্তের চারপাশে জমে থাকা ধুলো উড়ছে। নাকে ঢুকে গেছে তার।
দরজার বাইরে তাকিয়ে দেখল কিশোর, কেউ আসছে কিনা। প্রচুর হই চই হচ্ছে। হট্টগোল কানে গেলে দেখতে আসতে পারে।
গর্তের ভেতরে উঁকি দিল মুসা। বদ্ধ বাতাসের ভাপসা গন্ধ লাগল নাকে।
কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না, বলল সে। টর্চ আছে?
দিনের বেলা, তাই টর্চ আনার কথা ভাবিইনি, জবাব দিল কিশোর।
ছাউনিটাতে আছে কিনা দেখে আসি, বলে উঠে চলে গেল রবিন। ফিরে বেএসে জানাল, টর্চ নেই, তবে ম্যাচ পেয়েছি। এই যে।
বাক্সটা হাতে নিয়ে ঝাঁকি দিল কিশোর। ভরা নয়, অল্প কয়েকটা কাঠি। খস করে একটা কাঠি জ্বেলে জ্বলন্ত কাঠি সহ হাতটা নামিয়ে দিল নিচে।
ইটের তৈরি একটা সিঁড়ি নেমে গেছে।
কিশোরকে অবাক করে দিয়ে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঝাঁপটা মেরে নিভিয়ে দিল আগুনটা। দুই সহকারীর দিকে ফিরল সে। সিঁড়ি আছে যখন, নামা যায়, কি বলো?
ভূতের ভয় থাকা সত্ত্বেও আমতা আমতা করে রাজি হয়ে গেল মুসা। রবিন তো আগেই রাজি।
সাবধানে খাড়া সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নামতে শুরু করল ওরা। কাঠি মাত্র কয়েকটা, নিতান্ত প্রয়োজনের সময় ছাড়া জ্বালবে না ভেবে অন্ধকারেই অনুমানে নির্ভর করে নামছে কিশোর। পা ফসকাল মুসা। পড়ে যেতে যেতে কোনমতে সামলাল। গোড়ালি মচকে ফেলেছিল আরেকটু হলেই।
আরে কি করছ! চিৎকার করে উঠল কিশোর।
সরি! বিড়বিড় করল মুসা। আই কিশোর, আরেকটা কাঠি জ্বালো না। মনে তো হচ্ছে কবরের মধ্যে ঢুকেছি, বাপরে বাপ, যা অন্ধকার! কি জায়গারে এটা!
কি আর? এখানে দিনদুপুরেও ভ্যাম্পায়ারেরা ঘোরাফেরা করে, ফিসফিস করে বলল রবিন, ভয় পাওয়ার ভান করছে। আরেকটু সামনে এগোলেই হয়তো হোঁচট খাব ড্রাকুলার কফিনে…
দোহাই তোমার, রবিন, তেনাদের নিয়ে হেলাফেলা কোরো না…! কেঁপে উঠল মুসার গলা।
আরেকটা কাঠি জ্বালল কিশোর। নিচু ছাত। সাদা রঙ করা দেয়ালের বহু জায়গায় প্লাস্টার খসে গেছে, ছাতলা পড়া। আরেক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগল। গায়ে কাঁটা দিল কিশোরের। আগুন দেখে জাল বেয়ে তাড়াহুড়া করে সরে যেতে লাগল একটা মাকড়সা। আলোটা নিভে যাওয়ার আগের মুহূর্তে চোখে পড়ল ওদের, একদিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো একটা ওয়াইন র্যাক, আরেক দিকে সম্ভবত কয়লার স্তূপ। সিঁড়িও আছে আরেকটা।
এটাই বোধহয় সেই সেলার, মুসা বলল, মিস্টার সেভারন যেটার কথা বলেছিলেন।
আমি যে পুরানো প্ল্যানটা কপি করে এনেছি, রবিন বলল, তাতেও আছে। এটা।
আরেকটা কাঠি জ্বালল কিশোর। দেখতে দেখতে বলল, জায়গাটা যেন কেমন। গা ছমছম করে, তাই না?
তুমিও বলছ এ কথা! জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে মুসা। দেখা তো হলো? চলো, যাইগে…
আস্তে! থামিয়ে দিল ওকে কিশোর। কথা বলে কারা?
মাথার ওপর থেকে আসছে চাপা কথার শব্দ।
মিস্টার সেভারন নাকি? বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর।
নিজেরা দুজন ছাড়াও আরও কেউ আছে, রবিন বলল। কে?
মিসেস ড্রাকুলা চলে আসেনি তো সাতসকালে উঠে? মুসার প্রশ্ন।
দম বন্ধ করে, কান পেতে শুনতে লাগল তিনজনে। পাথরের মেঝেতে চেয়ারের পায়া ঘষার শব্দ শুনে বুঝল রান্নাঘরটা ওদের ওপরে কোথাও রয়েছে। কথা শোনা যাচ্ছে ওঘর থেকেই।
আরেকটা সিঁড়ি যে দেখলাম, সেটা দিয়ে উঠে দেখা যেতে পারে কোথায় উঠলাম, প্রস্তাব দিল কিশোর।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে সেটা বরং ভাল, সঙ্গে সঙ্গে বলল মুসা।
এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। তর সইছে না মুসার। আগে আগে উঠতে শুরু করল সে। তার পেছনে থেকে কাঠি জ্বেলে সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে রাখল কিশোর। সবার পেছনে রবিন।
সিঁড়ির মাথায় উঠে আরেকটা কাঠি জ্বালল কিশোর। ট্র্যাপ-ডোর দেখা গেল এখানেও।
এটা কি? ডোরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা একটা জিনিস ধরে টান দিল রবিন। বের করে আনল।
কাঠির আলোয় দেখতে দেখতে বলল কিশোর, কাপড়। পোশাক থেকে ছিড়ে গেছে। দেখো, কি রকম পাতলা, ফিনফিনে…
শিউরে উঠল মুসা, খাইছে! তারমানে মিসেস সেভারন ভুল দেখেননি, সত্যি সত্যি ভূত আছে…
ফালতু কথা বাদ দিয়ে ঠেলা দাও, কিশোর বলল।