কিন্তু জোরে ছোটার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল ঘোড়াটা। শেষে রাশ খানিকটা ঢিল করে ওকে ছুটতে দিল মুসা। মুহূর্তে যেন উড়ে এসে বনের রাস্তায় ঢুকল ফায়ার। সামনে ঝুঁকে বসে রইল মুসা। রেকাবে আরও টান টান হয়ে গেছে পা। সে-ও ছোটার জন্যে প্রস্তুত। কিন্তু অচেনা পথে জোরে ছুটতে অস্বস্তি হতে লাগল তার। দৌড়ানো থামাল হায়ারের। দুলকি চালে চলল কয়েক মিনিট। শেষে আবার হাঁটাতে শুরু করল আগের মত। হাত লম্বা করে আস্তে চাপড়ে দিল ঘোড়াটার ঘামে ভেজা ঘাড়।
দারুণ ছুটতে পারিস তুই, ফায়ার! হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নিজের কপাল থেকেও ঘাম মুছল মুসা। সত্যি, প্রশংসা করার মত!
রেকাবে পায়ের ভর রেখে উঠে দাঁড়াল সে। পা দুটো ছড়ানোর জন্যে। চোখে পড়ল সাদা ভ্যানটা। আগের দিন যেখানে ছিল, ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
এখানে কি করছে ও, এত সকালে! প্রথমেই এই ভাবনাটা এল মুসার মাথায়। নিশ্চয় উঁকিঝুঁকি মারতে এসেছে সেভারনদের বাড়িতে। আরও অঘটন দুটানোর তালে আছে।
ঘোড়া থেকে নামল সে। মাথার টুপিটা খুলে একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখল। ফায়ারকে বাঁধল গাছের সঙ্গে। গলাটা চাপড়ে দিয়ে বলল, থাক এখানে, ফায়ার, ঘাস খা। আমি গিয়ে ভ্যানটা দেখে আসি। বেশিক্ষণ লাগবে না।
ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়ল সে। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে এগোল গাড়িটার দিকে। পেছনে আঁকা সেই লোগো, এখন আর অপরিচিত নয়। জানালা দিয়ে ভেতরে দেখল। পেছন দিকে এসে হাতল ধরে মোচড় দিতেই খুলে গেল। দরজাটা।
খাইছে! আপনমনেই বলে উঠল সে, ভাগ্যটা ভালই আমার!
আশেপাশে কেউ আছে কিনা দেখে নিয়ে উঠে বসল ভ্যানের মধ্যে। লাগিয়ে দিল দরজাটা।
মেঝেতে পড়ে আছে একটা শটগান। পাশে রাখা এক বাক্স কার্তুজ। জান কি দেখবে, তবু সন্দেহ নিরসনের জন্যে ডালাটা খুলে দেখল। সেদিন এই কার্তুজ দিয়েই গুলি করা হয়েছিল। সন্দেহ নেই। দুটো কার্তুজ তুলে নিয়ে পকেটে রাখল। চোখ বোলাল আর কি আছে দেখার জন্যে। এক কোণে একটা প্লাস্টিকের কনটেইনার, গায়ে মড়ার খুলি আর ক্রসবোন আঁকা স্টিকার লাগানো। মুখটা খুলে গন্ধ শুকল। পোকা মারার বিষ। একই রকম গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল সেভারনদের বাগানের পুকুরে।
হাসি ফুটল মুসার ঠোঁটে। ঘুরতে এসে শাজিনদের বিরুদ্ধে এ রকম জোরাল প্রমাণ পেয়ে যাবে আশা করেনি। ভ্যান-চালকের চেহারাটা এখন দেখা দরকার, চিনে নেয়া দরকার, তারপর নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে পারে।
গাড়ি থেকে নামতে যাবে, এই সময় কানে এল পায়ের শব্দ। ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলল সে। ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে গেল। আতঙ্কিত হয়ে শুনতে পেল, ইগনিশনে চাবি ঢোকানোর শব্দ এবং তারপর ইঞ্জিনের গর্জে ওঠা। মুসা কোন কিছু করার আগেই চলতে শুরু করল গাড়ি। গতি বেড়ে গেল মুহর্তে। অসহায় হয়ে গুটিসুটি হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
.
একভাবে পড়ে আছে মুসা। মাথা তুললেই আয়নায় তাকে দেখে ফেলবে। ড্রাইভার। ফলে লোকটার চেহারা দেখার জন্যেও মাথা তুলতে পারছে না।
মিনিট দশেক এক গতিতে গাড়ি চালিয়ে এসে ব্রেক কষে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। দরজা খুলে নামল। দড়াম করে লাগিয়ে দিল। সরে যেতে লাগল পায়ের শব্দ।
সব যখন চুপচাপ হয়ে গেল আবার, আস্তে মাথা তুলল মুসা। পেছনের জানালা দিয়ে তাকাল। রাস্তার ধারে বড় একটা বাড়ির সামনে থেমেছে গাড়িটা। রাস্তাটার দুই ধারেই গাছের সারি।
কোথায় এল সে? আশেপাশে তাকিয়ে চিনতে পারল না জায়গাটা। ড্রাইভারকে দেখা গেল না, তবে বাড়ির দোতলার জানালায় ছায়া নড়তে দেখল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কেউ।
আলো লাগছে চোখে। কপালের সামনে হাত এনে রোদ বাঁচিয়ে ভালমত তাকাল। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে হাত-আয়নায় চেহারা দেখে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছে এক মহিলা। লম্বা কালো চুল, মোমের মত সাদা চামড়া। শাজিনকে দেখেনি সে, রবিনের কাছে চেহারার বর্ণনা শুনেছে। মহিলাকে দেখেই এখন বুঝল, ও শাজিন ছাড়া আর কেউ নয়। ভ্যাম্পায়ারের কথা ভেবে কাঁটা দিল গায়ে। দিনের বেলা বেরোয় না ওই রক্তচোষা ভূত মনকে বুঝিয়ে জোর করে ভয় তাড়াল।
জানালার কাছ থেকে মহিলা সরে যেতেই দরজাটা খুলল সে। লাফ দিয়ে নামল। আবার লাগিয়ে দিল দরজা। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখল কেউ লক্ষ করছে কিনা। সরে এসে ভ্যানটাকে সামনে রেখে আড়াল করে বসে তাকাল আবার বাড়িটার দিকে।
চিৎকার শোনা গেল এই সময়। দেখল বাগানের রাস্তা ধরে তার দিকেই দৌড়ে আসছে মহিলা। বোঝা গেল, কোনভাবে দেখে ফেলেছে।
আর বসে থাকতে সাহস করল না মুসা। উঠেই দিল দৌড়।
এই এই, শোনো! চিৎকার করে ডাকল মহিলা।
ফিরেও তাকাল না মুসা।
.
রাস্তার শেষ মাথায় দেখতে পেল একটা পাবলিক পার্কে ঢোকার লোহার গেট। ওর মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে গাছের আড়ালে বা অন্য কোথাও লুকাতে পারবে। ফিরে তাকাল কাঁধের ওপর দিয়ে। পেছন পেছন দৌড়ে আসছে মহিলা। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভাবল মুসা, ফায়ার কাছাকাছি থাকলে লাফ দিয়ে গিয়ে এখন ওর পিঠে চড়ে বসতে পারত।
পার্কের মধ্যে এক জায়গায় ছুটাছুটি করে খেলছে বাচ্চারা। তাদের কাছে দৌড়ে এসে একটা স্লিপারের আড়ালে বসে পড়ল মুসা। আশা করল তাকে দেখতে পাবে না মহিলা।