দ্রুত অ্যালবামের বাকি পাতাগুলো দেখা শেষ করে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল কিশোর। টান লেগে ভেতর থেকে বেরিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল একটা চিঠির খাম। ওপরে ছাপ মারা একটা লোগো-কোন কোম্পানির নামের আদ্যক্ষর যুক্ত করে তৈরি। সাধারণ জিনিস। কৌতূহল জাগাল না কিশোরের। খামটা আবার আগের জায়গায় ঢুকিয়ে রাখল সে।
স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন মিসেস সেভারন।
ও কিশোর পাশা, পরিচয় করিয়ে দিলেন বৃদ্ধা। ভলান্টিয়ার সার্ভিসের সদস্য।
সোফা থেকে উঠে গিয়ে মিস্টার সেভারনের সঙ্গে হাত মেলাল কিশোর, হালো, মিস্টার সেভারন। অ্যালবামটা খুব সুন্দর। ম্যানটল পীসের ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ওটা কি আপনাদের ছেলের ছবি?
ছেলের কথা উঠতেই আড়ষ্ট হয়ে গেলেন দুজনে। তাদের ভঙ্গি দেখেই বুঝে গেল কিশোর, কি যেন গোপন করতে চাইছেন। অবাক হলো সে।
ইয়ে… আমতা আমতা করে জবাব দিলেন মিসেস সেভারন, ছুটিতে থাকার সময় ওর কোন বন্ধু হয়তো তুলেছিল ছবিটা। হঠাৎ করেই একদিন। ডাকে এসে হাজির, ও…
ও, কি? কৌতূহল হলো কিশোরের।
ও…ও চলে যাবার পর। অ্যালবামটা তুলে নিয়ে গিয়ে একটা ড্রয়ারে রেখে দিলেন মিসেস সেভারন।
তারমানে এখানে থাকে না আপনাদের ছেলে?
মাথা নাড়লেন মিসেস সেভারন। না।
ফায়ারপ্লেসের সামনের একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন মিস্টার সেভারন। ভঙ্গি এখনও আড়ষ্ট।
তাহলে কোথায়…? জিজ্ঞেস করতে গেল কিশোর।
দূরে থাকে, আচমকা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মিস্টার সেভারনের কণ্ঠ।
স্পষ্ট বোঝা গেল এই প্রসঙ্গে আর কথা বলতে চান না মিসেস সেভারনও। কোন স্কুলে পড়ো তুমি?
রকি বীচ হাই।
দুজনের আচরণে কৌতূহল বেড়ে গেছে কিশোরের। ছেলের সম্পর্কে কথা বলতে চান না কেন? বুড়ো মানুষেরা তো সাধারণত ছেলেমেয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই খুশি হয় বেশি, যতটা পারে বকর বকর করে, কিন্তু এরা ঠিক উল্টো। ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন নাকি?
কোথায় থাকো? জানতে চাইলেন মিস্টার সেভারন।
ইয়ার্ডের ঠিকানা জানাল কিশোর।
রকি বীচে কতদিন? মিসেস সেভারন জিজ্ঞেস করলেন।
বহু বছর। প্রায় জন্মের পর থেকে।
ভাল লাগে?
লাগে।
আমরাও আছি বলতে গেলে প্রায় সারাটা জীবনই। জ্যাকিও এখানেই জন্মেছে…
মিস্টার সেভারনের ভ্রূকুটি দেখে থেমে গেলেন মিসেস সেভারন। লক্ষ করল কিশোর।
এই কটেজটা কিনেছি মাত্র বছরখানেক আগে, আবার ছেলের প্রসঙ্গ চাপা দেয়ার চেষ্টা করলেন মিস্টার সেভারন। খুব ভাল লাগে জায়গাটা। শান্ত, নীরব; কোন গোলমাল ছিল না, কিন্তু…
অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর। পুরো এক মিনিট চুপ করে থাকার পরও যখন মুখ খুললেন না মিস্টার সেভারন, না জিজ্ঞেস করে আর পারল না সে, কিন্তু কি, মিস্টার সেভারন? কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে,
তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লেন মিস্টার সেভারন, না না, কি ঘটবে?
মিস কেলেট আমাকে বললেন বাড়িটাতে নাকি ভূতের উপদ্রব আছে।
অস্বস্তিভরা ভঙ্গিতে স্বামীর দিকে তাকাতে লাগলেন মিসেস সেভারন। সত্যি যেন ভূতের ভয়ে কাবু হয়ে আছেন।
হাসি ফুটল মিস্টার সেভারনের মুখে। অবাক করল কিশোরকে।
সব গাঁজা, বুঝলে। অতি কল্পনা। আমার স্ত্রী ভূতকে ভীষণ ভয় পায়।
সলজ্জ হাসি ফুটল মিসেসের মুখে। তুমিই তো ভয়ের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে ভয়টা বাড়াও আমার।
কিন্তু ঘর নাকি খুব ঠাণ্ডা হয়ে যায় মাঝে মাঝে, কিশোর বলল।
ঘরে রোদ না ঢুকলে তো হবেই, জোর দিয়ে কথাটা বলতে পারলেন না মিসেস সেভারন। এমনিতেই জায়গাটা বড় বেশি নীরব; দুপুরবেলায়ও গা ছমছম করে, তার ওপর…
তার ওপর কি? কিশোরের মনে হলো জরুরী কোন কথা বলতে চেয়েছিলেন মিসেস সেভারন। বলতে দিলেন না মিস্টার সেভারন। বাদ দাও ওর কথা, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। প্রসঙ্গটাকে হালকা করার জন্যে বললেন, আমার স্ত্রীর ভূতে আসর করা ঘরটা দেখবে নাকি?
দেখব না মানে! এক্ষুণি চলুন।
এসো, হাসলেন মিস্টার সেভারন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ওকে দেখিয়ে আনি। তুমি ততক্ষণে বাসনগুলো ধুয়ে ফেললো।
আপনাদের কষ্ট করার দরকার নেই, কিশোর বলল। ধোয়াধুয়িগুলোও আমরাই করব। আমাদের দায়িত্ব…
কোন অসুবিধে নেই, মিসেস সেভারন বললেন। বসেই তো থাকি। বরং কাজ করলে ভাল লাগবে। রান্না করে যে লাঞ্চ এনে খাওয়াচ্ছ, তাতেই আমরা কৃতজ্ঞ; কত কাজ আর ঝামেলা বাঁচাচ্ছ।
ধোও তুমি, আমরা যাচ্ছি, স্ত্রীকে বলে কিশোরের দিকে তাকালেন মিস্টার সেভারন। এসো।
এই সময় বাইরে গাড়ির হর্ন বাজল।
তাড়াতাড়ি গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে তাকাল কিশোর। এহহে, মিস কেলেট চলে এসেছেন! আর কয়েক মিনিট দেরিতে এলে কি হত… নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল সে। মিস্টার সেভারনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, অন্য কোন সময় এলে কি ঘরটা দেখাবেন?
নিশ্চয় দেখাব। যখন ইচ্ছে চলে এসো। এলে খুশিই হব। কথা বলার লোক পাই না।
পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করল কিশোর। বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নিন, রাখুন এটা। যদি কখনও কোন প্রয়োজন মনে করেন, ফোন করবেন।
কার্ডটা দেখলেন মিস্টার সেভারন। কিশোর গোয়েন্দা!…খুব ভাল। মুখ তুলে তাকালেন তিনি। কিন্তু প্রশ্নবোধকগুলো কেন? আত্মবিশ্বাসের অভাব?
এই প্রশ্নটা বহুবার বহুজনের মুখে শুনেছে কিশোর। দমল না। বলল, মোটেও না। বরং আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি আমাদের। প্রশ্নবোধকগুলো বসানোর তিনটে কারণ। এক, রহস্যের ধ্রুবচিহ্ন এই প্রশ্নবোধক। যে কোন রহস্য সমাধানে আগ্রহী আমরা। ছিঁচকে চুরি থেকে শুরু করে ডাকাতি, রাহাজানি, খুন, এমনকি ভৌতিক রহস্যের তদন্তেও পিছপা নই। দুই, চিহ্নগুলো আমাদের ট্রেডমার্ক। আর তিন, যেহেতু দলে তিনজন, তাই তিনটে চিহ্ন দেয়া হয়েছে। একটু থেমে বলল, কারও কাজ করে দেয়ার জন্যে পয়সা নিই না আমরা। গোয়েন্দাগিরি করাটা আমাদের শখ।