নিচু হয়ে নষ্ট করে ফেলা ফুলের বেডগুলো পরীক্ষা করতে লাগল সে। জুতোর ছাপ চোখে পড়ল। রাবার সোলের জুতো। গোড়ালিতে গোল গোল চক্র, ভালমতই দাগ বসে গেছে। আপনাদের ভয় দেখিয়ে ভড়কে দেয়ার জন্যেই এ কাজ করেছে শয়তানটা। মুখ তুলে মিস্টার সেভারনের দিকে তাকাল সে, যাতে কটেজ বেচে দিয়ে চলে যান।
জানি, তিক্তকণ্ঠে বললেন মিস্টার সেভারন। চলল, ঘরে চলো। একটা জিনিস দেখাব তোমাকে।
.
ঘরে পা দিয়ে মিসেস সেভারনকে রবিন আর মুসার কাছে বলতে শুনল কিশোর, …কাল রাতে আবার শুনেছি সেই অদ্ভুত শব্দ।
কটার সময়? জানতে চাইল রবিন।
রাত বারোটার দিকে বারোটায় শুরু হলো, কয়েক ঘণ্টা ধরে চলল।
বাতাসের শব্দ নয়তো? মুসা জিজ্ঞেস করল, যদিও তার সন্দেহ নেই ভতে করেছে ওসব শয়তানি। সত্যি, রাতের বেলা শব্দগুলো ভয়ঙ্কর লাগে শুনতে। ফায়ার পর্যন্ত মাঝে মাঝে ঘাবড়ে গিয়ে অস্থির হয়ে ওঠে।
আমার মনে হয় না বাতাসের শব্দ, মিসেস সেভারন বললেন। শুধু কি তাই… কাঁপা হাতে কার্ডিগানের পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে দিলেন। তিনি, দেখো!
মুসা বা রবিন ধরার আগেই এগিয়ে এসে চিঠিটা নিয়ে নিল কিশোর। খামের গায়ে নোংরা আঙুলের ছাপ। ভেতরে এক টুকরো কাগজ। তাতে টাইপ করে একটা লাইন লেখা। বাংলা করলে দাঁড়ায়:
কাল রাতে ঘুমাতে পেরেছ?
নীরবে কাগজটা রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিল কিশোর, যাতে রবিন আর মুসা দুজনেই দেখতে পারে।
খাইছে! দেখেই বলে উঠল মুসা। মিসেস সেভারনের দিকে তাকাল। কখন পেলেন?
সকালে। ডাকবাক্সে, গলা কাঁপছে মিসেস সেভারনের। কি করব আমরা, বলো তো? এই অত্যাচার আর তো সহ্য করতে পারছি না!
নীরবে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা।
সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে আস্তে করে তার বাহুতে হাত রাখল কিশোর। আজ রাতে এসে পাহারা দেব আমরা। কোনমতে যদি ধরতে পারি বাছাধনকে, জেলের ঘানি না টানিয়ে ছাড়ব না। কত্তবড় সেয়ানা লোক, দেখে নেব।
না না, এ কাজ করতে দেব না আমি তোমাদের! ওঁরা লোক ভাল না। বিপদ হতে পারে। খারাপ কিছু ঘটে গেলে কি জবাব দেব তোমাদের বাবা মার কাছে?
এ নিয়ে এক বিন্দু চিন্তাও আপনি করবেন না, অভয় দিল রবিন। বিপদে পড়লে কি করে উদ্ধার পেতে হয় জানা আছে আমাদের। শুনলে আমাদের আব্বা-আম্মা কিছু তো বলবেই না, বরং তারাও সাহায্য করতে চাইবে আপনাদের।
হ্যাঁ, রবিনের কথায় সুর মিলিয়ে বলল মুসা, কিছু চিন্তা করবেন না আপনারা।
হাসলেন মিসেস সেভারন। কিন্তু দ্বিধা যাচ্ছে না তাঁর। তবু, সাবধান থাকা উচিত তোমাদের।
তা তো থাকবই, জোর দিয়ে বলল কিশোর। আমাদের জন্যে চিন্তা করবেন না।
বিদায় নেয়ার আগে কিশোর জানতে চাইল, হুমকি দিয়ে লেখা নোটটা তার কাছে থাকলে কোন অসুবিধে আছে কিনা।
কি করবে এটা দিয়ে? জানতে চাইলেন মিস্টার সেভারন।
এখনও জানি না। তবে তদন্ত করতে গেলে কাজে লাগতে পারে।
বেশ, রাখো। কাজে লাগলে তো ভালই।
.
টাইপিঙের গোলমালটা চোখে পড়েছে তোমাদের? বাড়ি ফেরার সময় সাইকেল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ, রবিন বলল, ও অক্ষরটা সবখানেই বড় হাতের, বাক্যের শুরুতেও, বাক্যের মাঝখানেও। মেশিনের ওই কী টা নষ্ট। টিপতে গেলে বার বার ক্যাপিটল লেটারটাই ওঠে।
সেজন্যেই চিঠিটা নিয়ে এলাম। এই সূত্র ধরেই লেখকের আস্তানা আর তার নামটা খুঁজে বের করে ফেলতে পারব। তারপরে রয়েছে খামের ওপর আঙুলের ছাপ। প্রমাণও করা যাবে কে লিখেছে চিঠিটা, কোনমতেই পার পাবে না। বাগান যে তছনছ করেছে, তাকেও ধরা কঠিন হবে না। চিঠির লেখক আর বাগান তছনছকারী একই লোক হলে তো আরও ভাল।
সেভারনদের ওখানে কটার সময় যেতে হবে? জানতে চাইল মুসা। দেখি।
এগারোটার আগে গিয়ে বোধহয় লাভ হবে না।
.
উষ্ণ রাত। গা আঠা করা গরম। বাতাসে ঝড়ের সঙ্কেত। ওঅকশপের বেড়ায় হেলান দিয়ে রাখা সাইকেল তিনটা যখন সরিয়ে এনে চেপে বসল তিন গোয়েন্দা, এক টুকরো ঘন কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে চাঁদ।
ঝড় আসবে, আকাশের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল রবিন।
নৈশ অভিযানের ষোলোকলা পূর্ণ হবে তাহলে, শুকনো গলায় বলল মুসা।
কি আর হবে, শান্ত রয়েছে কিশোর, উত্তেজনাটা বাড়বে আরকি।.
সাইকেলের আলোটা জ্বেলে দিল সে। সামনের জঞ্জালের ওপর ছড়িয়ে পড়ল আলো। প্যাডালে চাপ দিয়ে বলল, চলো, যাই।
.
সেভারনদের বাড়িতে বনের কিনারে একটা ওক গাছের নিচে বসে আছে তিনজনে। মাথার ওপর বাতাসে মড়মড়, সরসর, কটকট করছে গাছের ডালপাতা। কালো মেঘের আড়াল থেকে মুহূর্তের জন্যে বেরিয়ে আবার ঢুকে গেল চাঁদটা। দূর থেকে ভেসে এল বস্ত্রের চাপা গুমগুম শব্দ। পৃথিবীটাকে গুঁড়িয়ে দেবার হুমকি দিচ্ছে যেন।
ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না আমার, পকেট থেকে চকলেট বের করে মোড়ক খুলতে শুরু করল মুসা। শুধু চোর-ডাকাত হলে এক কথা ছিল, মানুষকে আমি কেয়ার করি না, কিন্তু…
একটা পেঁচা ডাকল ওকের ডালে। কাঁপা, কর্কশ, ভুতুড়ে ডাক ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। সেই সঙ্গে বাতাসের ক্রুদ্ধ ফিসফিসানি মিলে এক ভয়ানক পরিবেশ সৃষ্টি করল। গায়ে কাঁটা দিল মুসার। সরে এসে গা ঘেঁসে বসল দুই সঙ্গীর মাঝখানে।
অন্ধকারে মুচকি হাসল রবিন। ফিসফিস করে বলল, এমন রাতেই ভ্যাম্পায়ারেরা বেরোয়। সেই সিনেমাটাতে দেখোনি, দুটো টিনএজার ছেলেমেয়ে কিভাবে রক্ত খেতে বেরিয়েছিল রাত দুপুরে…