চারপাশে তাকাতে লাগল কিশোর। সামার-হাউসের দরজা খোলা, কিন্তু কাউকে চোখে পড়ল না। কয়লা রাখার বাংকারটার ওপরে উঠে ফ্যানলাইট উইন্ডোর ফাঁক হয়ে থাকা পাল্লার ভেতর দিয়ে উঁকি দিল।
মাথার ওপর দিয়ে একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছে। ওটা চলে যাওয়ার পর যখন শব্দ সরে গেল একটা ঠনঠন শব্দ কানে এল। হাতুড়ি দিয়ে ধাতব কিছু পিটাচ্ছে। কেউ। তারপর কটেজের ভেতরে আসবাব টানাটানি করার শব্দ। ভুরু কুঁচকে তাকাল সে। সেভারনরা যদি ডে সেন্টারেই চলে গিয়ে থাকেন, কে টানাটানি করছে?
মিস্টার সেভারন, মিস্টার সেভারন বলে ডাক দিল সে।
জবাব নেই।
ভেতরে ঢুকে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে সামার-হাউসে ঢুকে পড়ল সে। পুরানো একটা গুটিয়ে রাখা কার্পেটের পাশে তারের তৈরি পুরানো দুটো কোটের হ্যাঁঙ্গার। একটা হ্যাঁঙ্গার নামিয়ে এনে তারের মাথা যেখানে জোড়া দেয়া, সেখানটা খুলে ফেলল। তারটা সোজা করল টেনে টেনে। মাথার কাছটা সামান্য বাঁকিয়ে নিল বঁড়শির মত করে। ফিরে এসে আবার চড়ল কোল বাংকারে। ছোট ফ্যানলাইট জানালার মধ্যে তারের বাঁকা মাথাটা ঢুকিয়ে ভেতরের হুড়কো খুলে ফেলল। মূল পাল্লাটা পুরো খুলে ফেলতে আর কোন, অসুবিধে হলো না। এবার ঢোকা যাবে ওপথে।
ভাবনা চলেছে ওর মাথায়। ভেতরে যদি কেউ থেকেই থাকে, তাহলে কোনদিক দিয়ে ঢুকল সে? যদি এ জানালাটা দিয়ে ঢুকত, তাহলে আর হুড়কো লাগাত না, ভোলা রাখত, যাতে তাড়াহুড়োর সময় দ্রুত বেরিয়ে যেতে পারে।
দুরুদুরু করছে বুকের মধ্যে। জানালা গলে ভেতরে ঢুকল কিশোর। আস্তে করে আবার লাগিয়ে দিল পাল্লা।
দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল একটা মুহূর্ত। ঢোকার আগে রবিনকে ডেকে এনে পাহারা দেয়ার জন্যে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলে ভাল হত। এখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই।
হঠাৎ একটা জোরাল শব্দে চমকে গেল সে। ভূতে আসর করা ঘরটা থেকে আসছে।
আস্তে করে দরজা খুলে সরু হলওয়ে ধরে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল কিশোর। ভূতের ঘরের ভারী ওক কাঠের দরজাটা বন্ধ। তাতে কান চেপে ধরল
ভেতর থেকে আসছে ঠোকাঠুকির শব্দ। বিড়বিড় করে আপনমনে কথা বলছে কেউ।
খুব সাবধানে পিতলের নবটা চেপে ধরে ঘোরানো শুরু করল কিশোর। পুরোটা ঘুরে যেতে ঠেলা দিল। খুলে গেল দরজা। ঠাণ্ডা বাতাস এসে ধাক্কা মারল যেন গালে।
কি… বলতে গেল সে।
কালো একটা মূর্তি ঝুঁকে রয়েছে আগুনের ধারে পাতা টেবিলে রাখা টিনের ট্রাংকটার ওপর। ঝট করে সোজা হয়ে ফিরে তাকাল। চমকে গেল কিশোরকে দেখে। পরনে কালো জিনস, গায়ে কালো কমব্যাট জ্যাকেট। মাথার ব্যালাক্লাভা ক্যাপ টেনে নামিয়ে মুখ ঢেকেছে। চোখের জায়গার দুটো ফুটো দিয়ে কালো একজোড়া চকচকে মণি দেখা যাচ্ছে। লোকটা বেশ লম্বা। কেমন ঝুলে পড়া মেয়েলী কাঁধ।
তালা ভেঙে খোলা হয়েছে ট্রাংকটা। কাছেই পড়ে আছে একটা হাতুড়ি। বাইরে থেকে এই তালা ভাঙার শব্দই কানে এসেছিল।
তাড়াতাড়ি ট্রাংকের ভেতর থেকে একমুঠো দলিল তুলে নিল লোকটা। ওগুলো বেধে রাখা লাল ফিতেটা ঢিল হয়ে আছে।
কে আপনি? জিজ্ঞেস করল কিশোর। কি করছেন?
কাগজগুলো দ্রুত পকেটে ভরার চেষ্টা করল লোকটা। ঢোকাতে না পেরে হাত থেকে ছেড়ে দিল। তুলে নিল হাতুড়িটা।
সরো এখান থেকে! যাও! কিশোরের দিকে তাকিয়ে বিকৃত কণ্ঠে গর্জে উঠল সে। হাতুড়িটা ঝাঁকাতে লাগল বাড়ি মারার ভঙ্গিতে।
দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মগজে। কি করা যায়? দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে যদি এখন দরজার তালাটা লাগিয়ে দিতে পারে, ঘরে আটকা পড়বে লোকটা। তারপর পুলিশকে ফোন করলে বাতিল করে দিল ভাবনাটা। ঘরে আটকে থাকবে না লোকটা। জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে।
ভাবার সময় কম। কাছে চলে এসেছে লোকটা। লাফ দিয়ে পেছনে সরে। গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল কিশোর। দৌড় দিল সিঁড়ির দিকে।
কিছুদূর উঠে ফিরে তাকিয়ে দেখল সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে গেছে লোকটা। দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কালো চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে যেন সম্মোহিত করার চেষ্টা করছে ওকে।
বাইরে থেকে ডাক শোনা গেল এই সময়, কিশোর, কোথায় তুমি?
রবিন!
বুকের মধ্যে রক্ত ছলকে উঠল কিশোরের। চিৎকার করে বলল, রবিন, সাবধান!
গজগজ করে কি যেন বলল লোকটা। এদিক ওদিক তাকিয়ে পালানোর পথ খুঁজল। সোজা গিয়ে সামনের দরজার শেকল সরিয়ে, দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
রবিনের চিৎকার শোনা গেল, অ্যাই, অ্যাই!
দৌড়ে নেমে এল কিশোর। সামনের দরজার সামনে এসে দেখল, রাস্তাটার দিকে বোকা হয়ে তাকিয়ে আছে রবিন।
কিশোর, লোকটা কে? আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে চলে গেল।
চোর! চোর! চিৎকার করে উঠল কিশোর। লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে গেটের দিকে ছুটল। পলকের জন্যে দেখল মোড়ের ওপাশে চলে যাচ্ছে। লোকটা।
চোর! পেছনে প্রায় কানের কাছে শোনা গেল রবিনের চিৎকার। ঢুকল কি করে?
জানি না, মাথা নাড়তে নাড়তে বলল কিশোর।
কি নিতে এসেছিল? দামী গহনা-টহনা আছে নাকি?
দেখার সময় পাইনি। কতগুলো কাগজ ঘাটতে দেখলাম।
তাহলে দেখে ফেলো না।
এসো।
ভুতের ঘরটায় ফিরে এল ওরা। ট্রাংকের জিনিসগুলো ছড়িয়ে আছে মেঝেতে।
এটা কি? লাল ফিতেয় বাঁধা কাগজের বান্ডিলটা মেঝে থেকে তুলে নিতে নিতে বলল রবিন।