কিন্তু তার সে ইচ্ছে আর পূরণ হলো না। হঠাৎ গুঙিয়ে উঠে বুক চেপে ধরলেন। পিস্তলটা পড়ে গেল হাত থেকে। টলে পড়ে যাচ্ছেন। ধরার জন্যে ছুটে গেল কিশোর।
ঠিক এই সময় বাজ পড়ল। প্রচণ্ড শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল বন, পাহাড়, মাটি। চোখের কোণ দিয়ে পলকের জন্যে দেখতে পেল কিশোর, আকাশ থেকে তীব্র নীল একটা আগুনের শিখা ছুটে এসে লাগল বিলির মাথায়।
.
১৬.
লস অ্যাঞ্জেলেস স্টেট সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালের চওড়া করিডরে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। দরজায় লাগানো অভঙ্গুর কাচের মধ্যে দিয়ে বিলি ফক্সের সেলের ভেতরে তাকাল। ছোট্ট ঘর। টেলিভিশনের দিকে চেয়ে আছে বিলি। ভাবলেশহীন চেহারা। শূন্য দৃষ্টি। বোঝা যাচ্ছে অনুষ্ঠান দেখছে না। দেখার মত অবস্থাও নাকি নেই ওর। সেদিনকার সেই বিদ্যুৎ-ঝড় ওর মনকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে। এটা অবশ্য ডাক্তারদের কথা।
কিশোর এই রায় বিশ্বাস করতে রাজি নয়। বিলির মাথায় বাজ পড়তে দেখেছে নিজের চোখে। সঙ্গে সঙ্গে মরে যাওয়ার কথা ওর। মাটিতে পড়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মরেনি। কয়েক মিনিটের জন্যে অবশ হয়ে গিয়েছিল। হাত-পা। নড়াচড়া করেনি। সেই সুযোগে মাথায় পিস্তলের বাড়ি মেরে ওকে বেহুশ করেছিল মুসা। শেরিফের গাড়ি থেকে দড়ি এনে হাত-পা বেঁধে ফেলেছিল।
হিলটাউন কমিউনিটি হাসপাতালের ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে রেখে কয়েক ঘণ্টা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর ডাক্তাররা তাকে এখানকার হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। সেটা দুদিন আগের কথা।
আজকে তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে তিন গোয়েন্দা। কিন্তু কিশোরের ধারণা, ও ওদের সঙ্গে কথা বলতে চাইবে না। তবুও এসেছে। যদি বলে।
দেখা করার অনুমতির জন্যে একজন নার্সকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে অপেক্ষা করছে কিশোর, এই সময় পায়ের শব্দে ফিরে তাকিয়ে দেখে ডক্টর এলিজা আসছে।
কখন এলেন?
এই তো, পনেরো মিনিট।
বিলিকে দেখতে নিশ্চয়?
মাথা ঝাঁকাল এলিজা। এখানে বিলিকে আনার পর থেকেই দিনে কয়েকবার করে এসে তাকে দেখে যাচ্ছে সে। তোমরা?
আমরাও দেখা করতে। অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা করছি।
দরজার কাচের ভেতর দিয়ে বিলিকে দেখল এলিজা। আবার কিশোরের দিকে ফিরল। করোনারের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। শেরিফ রবার্টসনের মৃত্যুটাকে দুর্ঘটনা বলে রায় দিয়েছেন তিনি।
বজ্রপাতে মৃত্যু?
মাথা ঝাঁকাল এলিজা। ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির সঙ্গেও কথা বলেছি। কেসটা কিভাবে সাজাবেন বুঝতে পারছেন না তিনিও।
যে টেস্টগুলো করাতে বলেছিলাম, করিয়েছেন?
করিয়েছি?
কি বুঝলেন?
সব ঠিক আছে। ইলেকট্রোলাইট, ব্লাড গ্যাস লেভেল, ব্রেন ওয়েভ…সব আর দশজন সাধারণ মানুষের মত।
অস্বাভাবিক কোন কিছু নেই শরীরে? কিছুই না?
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল এলিজা। কি করে এটা আন্দাজ করেছিলে, বলো তো?
করাটাই স্বাভাবিক…এরকম অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী সচরাচর হয় না কোন মানুষ। বিদ্যুৎ হজম করতে পারে কেউ কেউ, কিন্তু পাচার করতে পারে। বলে শুনিনি কখনও।
দ্বিধা করতে লাগল এলিজা। অকারণে কেশে গলা পরিষ্কার করল। তারপর বলল, ডাক্তারি শাস্ত্রে এটা বিস্ময়কর এক ঘটনা। মানুষের দেহযন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা! যে যন্ত্র দিয়ে কাজটা করেছে বিলি, সেটা দেখতে অনেকটা বৈদ্যুতিক বান মাছের বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্রের মত। জন্ম থেকেই হয়তো ছিল ওটা ওর শরীরে। জন্মের সময় খুব ছোট ছিল, অক্ষম, ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। বজ্রপাতের পর কোনভাবে চার্জ হয়ে গেছে ওটা।…প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়াল! ওকে নিয়ে ভালমত গবেষণা করা দরকার।
হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। বিলির দিকে তাকাল। ডাক্তাররা যতই বলুক সব ধুয়ে মুছে গেছে, বিলির ক্ষমতা কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়নি।
ভুরু কোঁচকাল এলিজা। কি করে বুঝলে?
টেলিভিশনের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন।
ঘুরে গেল তিন জোড়া চোখ।
একের পর এক চ্যানেল পরিবর্তন হচ্ছে টেলিভিশনের।
এলিজা বলল, কিছু তো বুঝতে পারছি না।
চ্যানেল পরিবর্তন হচ্ছে, সেটা দেখছেন?
হ্যাঁ, কিন্তু এতে
কি দিয়ে বদলাচ্ছে ও? রিমোট তো হাতে নেই।
এতক্ষণে মুসা আর রবিনও লক্ষ করল, রিমোটটা টেলিভিশনের ওপরেই ফেলে রাখা হয়েছে। বেশ খানিকটা দূরে বসে পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে বিলি।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল এলিজার। ঠিক থাকাটা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ওর এই ক্ষমতা নষ্ট না করে না দিলে তো আবার শুরু করবে শয়তানি।
দেখুন চেষ্টা করে, পারেন কিনা? তাহলে আবার স্বাভাবিক মানুষ হয়ে যাবে বিলি।
যা-ই বলো, ওর সঙ্গে তোমাদের দেখা করতে যাওয়া উচিত হবে না মোটেও! তোমরা ওর এক নম্বর শত্রু। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে কখন কি করে, বসে…
ফিরে এল নার্স। যাকে অনুমতির জন্যে পাঠিয়েছিল কিশোর।
অনুমতি পাওয়া যায়নি। ওদের দেখলে খেপে উঠতে পারে বিলি, ডাক্তারেরও এটাই ধারণা।
এলিজা বলল, আমি ইচ্ছে করলে অনুমতি এনে দিতে পারি। কিন্তু, আবারও বলছি, উচিত হবে না।
দরজার বাইরে থেকেই বিলির সঙ্গে কথা বলার শেষ চেষ্টা করল কিশোর। চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকল।
সাড়া দিল না বিলি। মুখও তুলল না। একভাবে তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের দিকে। কিশোর ডাকাডাকি শুরু করলে একটা পরিবর্তনই শুধু ঘটল, টেলিভিশনের চ্যানেল বদলানো বন্ধ হয়ে গেল।