কোথায় যাচ্ছে, নিজেও জানে না মিলি। একটাই চিন্তা, ওই দানবটার। কাছ থেকে সরে যেতে হবে যত দূরে পারা যায়। বাঁচতে হলে ওর দৃষ্টির আড়ালে থাকতে হবে। অন্ধকার রাত। কুয়াশা পড়ছে। বনের মধ্যে আরও বেশি অন্ধকার। এখানে হয়তো ওকে দেখতে পাবে না বিলি। কিন্তু বলা যায় না কিছু। দেখার অলৌকিক চোখও থাকতে পারে ওর, কে জানে!
ঠিক এই সময় ঝোপের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে এসে পড়ল একটা ছায়ামূর্তি। ওকে জাপটে ধরল। চিৎকার করতে যাচ্ছিল মিলি। মুখ চেপে ধরল। সাড়াশির মত কঠিন আঙুল। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ওকে ঘন ঝোপের মধ্যে।
কোনমতে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল মিলি। ভেবেছিল বিলির জলন্ত চোখে চোখ পড়বে। কিন্তু তার বদলে অস্পষ্ট একটা অবয়ব ফুটতে দেখল আকাশের পটভূমিতে। চুলগুলো যেন কেমন। চেহারার কিছুই বোঝা গেল না। দানবের হাত থেকে ভূতের খপ্পরে এসে পড়ল নাকি!
ফিসফিস করে বলল ভূতটা, ভয় পেয়ো না, মিলি! আমি মুসা। একদম চুপ করে থাকবে। টু শব্দ কোরো না। কাছাকাছিই আছে ও।
ঝোপের মধ্যে মিলিকে নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল মুসা। মাঠ পেরিয়ে আসতে দেখল বিলিকে।
ওকে আর রবিনকে কেবিনে পাহারায় রেখে কিশোর চলে যাওয়ার পর মুসা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কেবিনের বাইরে। অন্ধকার ছায়ায় গা মিশিয়ে বিলির আসার অপেক্ষা করছিল। রবিন ভেতরে, সে বাইরে, দুজন দুই জায়গায় থেকে পাহারা দিচ্ছিল।
বিলি যখন মিলিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল, নিঃশব্দে পিছু নিয়েছিল ওর। ওকে পরাস্ত করার জন্যে সুযোগ খুজছিল। কোন উপায় দেখেনি। যে লোক শুধুমাত্র ইচ্ছা-শক্তির সাহায্যে একজন মানুষকে মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারে, তার সঙ্গে সামনাসামনি লাগতে যাওয়া চরম বোকামি। সেই বোকামি করেনি মুসা। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
মিলি যখন বিলির কাছ থেকে সরে যেতে শুরু করল, ওকে সাহায্য করার জন্যে পিছে পিছে ছুটল মূসা। অবশ্যই গাছপালা আর ঝোপের আড়ালে থেকেছে। সাবধান ছিল, বিলির চোখে যাতে না পড়ে…
মিলি! মিলি! ডাকছে আর শিশুর মত ফোপাচ্ছে বিলি। কোথায় তুমি? সাড়া দাও। প্লীজ। আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। মাথায় তুলে রাখব। মিলি! মিলি!
আরও কাছে চলে এল সে। কাঁদতে লাগল।
কিন্তু তাকে শান্ত করার জন্যে ঝোপ থেকে বেরোল না মিলি। ওই দানবের সামনে যেতে চায় না আর। ওর কাছে গেলে ওর কথা মানতে হবে। সেটা মানা সম্ভব নয় মিলির পক্ষে। না মানলে ধৈর্য হারিয়ে এক সময় না এক সময় রেগে উঠবে বিলি। মায়াদয়ার বালাই না রেখে তখন ধ্বংস করে দেবে ওকেও।
কি চাই তোমার, মিলি? কাঁদতে কাঁদতে বলছে বিলি। যা চাও তাই দেব! সব দেয়ার ক্ষমতা আছে আমার।
কুয়াশার চাদর ভেদ করে জ্বলে উঠল একটা আলোক রশ্মি। টর্চ। কঠিন কণ্ঠে আদেশ দিলেন শেরিফ, অ্যাই, ঘোরো এদিকে! তোমার কি হয়েছে জানি না আমি। তবে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব চাই।
আমি কোন প্রশ্নের জবাব দেব না! চিৎকার করে বলল বিলি। বরং আমার কথার জবাব চাই। ও কোথায়? মিলি কোথায়?
গাছের মাথা কাঁপিয়ে দিয়ে যেন ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল একঝলক ঝোড়ো বাতাস।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে উঠল বিলি, জবাব দিচ্ছ না কেন আমার কথার? কোথায় আছে ও? খুঁজে বের করো! জলদি!
মেঘ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো।
কিশোর এসে দাঁড়াল শেরিফের পাশে। হাতে উদ্যত পিস্তল। ফিসফিস করে বলল, কোন কিছু করতে যাবেন না এখন, শেরিফ। চোখের পলকে মেরে ফেলবে আপনাকে ও।
কিন্তু রোখ চেপে গেছে শেরিফের। ওর শয়তানির নিকুচি করি আমি। তুমি সরো!
ওদের কারও দিকেই আর নজর নেই এখন বিলির। আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করেই চলেছে। মেঘের কাছে, বাতাসের কাছে, বিদ্যুতের কাছে ওর প্রশ্নের জবাব চাইছে। বার বার একই কথা জিজ্ঞেস করছে–মিলি কোথায়? মিলি কোথায়? মিলি কোথায়?
রাগে হাত মুঠো করে ওপর দিকে তুলে আঁকাতে লাগল সে। কিন্তু মেঘ ওর প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। ক্রমেই রেগে যাচ্ছে বিলি। আক্রোশ গিয়ে পড়ল বনের ওপর। ওই গাছই মিলিকে আড়াল করে রেখেছে।
মনকে আদেশ দিল সে। ভয়াবহ বজ্র-বাণ ছুটে গিয়ে আঘাত হানল একটা গাছের মাথাকে। গ্রেনেড ফাটার মত বিস্ফোরণ ঘটল যেন। আগুন লেগে গেল গাছের মাথায়। কয়েকটা ডাল ফেটে চৌচির হয়ে গোড়া ভেঙে ঝুপঝুপ করে পড়ল মাটিতে।
আরেকটা গাছের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল বিলি। তারপর আরেকটা। আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করতে লাগল। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে যেন।
ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশও যেন খেপে উঠতে লাগল। ফুলে উঠল মেঘ। বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল ঘনঘন। বিকট শব্দে বাজ পড়ল।
মহা খেপা খেপেছে যেন আজ দুই দানব। একজন মাটিতে। আরেকজন আকাশে। দুটোতে মিলে প্রলয় কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়বে। তছনছ করে দেবে। বেচারা হিলটাউন শহরটাকে।
তাজ্জব হয়ে এই কাণ্ড দেখছেন শেরিফ। কিন্তু বেশিক্ষণ চলতে দেয়া যায় না এসব। মহাক্ষতি করে দেবে তাহলে বিলি। পিস্তল তুলে আচমকা গর্জে উঠলেন, বিলি, থামো! থামো বলছি! নইলে গুলি করব বলে দিলাম!
ফিরে তাকাল বিলি। বিদ্যুতের আলোয় বাঘের চোখের মত জ্বলছে ওর। দুই চোখ।
পিস্তল হাতে এগিয়ে গেলেন শেরিফ। বিলিকে হাতকড়া পরানোর ইচ্ছে।