কোন সন্দেহ নেই। কানের ভুল নয় তার। লম্বা করে দম নিল। সিঁড়িতে এক ধরনের গন্ধ। ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না গন্ধের রকমটা। তবে সচল বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে বোঝাই ঘরে যে রকম গন্ধ পাওয়া যায়, অনেকটা সেরকম।
উত্তেজনায় টানটান স্নায়ুগুলোকে ঢিল করার চেষ্টা চালাল সে। সেটা করা সম্ভব নয় আর এখন কোনমতেই। বরং পিস্তলটায় আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল হাতের আঙুলগুলো। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। আক্রমণ করতে আসা বিলিকে দেখামাত্র গুলি করবে।
কিন্তু কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না। বরং নষ্ট করে দেয়া সার্কিট ব্রেকারটা চোখে পড়ল। তারের সঙ্গে পেন্ডুলামের মত দুলছে এপাশ ওপাশ। বাক্সটা যেন প্রচণ্ড আক্রোশে টেনে খুলে আনা হয়েছে। ছেঁড়া তারের মাথা একটার সঙ্গে আরেকটা লাগলেই বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ ছুটছে। চড়চড় ফড়ফড় আওয়াজটা হচ্ছে তখনই।
পিস্তল নামাল কিশোর। হতাশ হয়েছে। বিলি এখানে এসেছিল সন্দেহ নেই। স্পষ্ট প্রমাণ রেখে গেছে। এখন কোথায়?
*
হিলটাউন কমিউনিটি হাসপাতালের অন্ধকার করিডর ধরে শিকারী বিড়ালের মত এগিয়ে চলেছে বিলি। ভাল বলতে আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই ওর মাঝে। ওর নিজেরই মনে হচ্ছে বহুদূরে কোথাও ফেলে এসেছে সেসব। কিন্তু তাই নিয়ে কোন আফসোস নেই ওর। একটা চিন্তাই রয়েছে তার মন জুড়ে। একটা চেহারা। মিলি হাওয়ার্ড!
শিরায় বইছে প্রচুর পরিমাণে অ্যাড্রেনালিন। অতি সতর্ক করে তুলেছে তাকে। অতিরিক্ত সচেতন। অনুভব করছে বৈদ্যুতিক-জ্যোতি ঘিরে ফেলছে তাকে, অনেকটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মত। দেয়ালের ভেতরের বৈদ্যুতিক তারগুলোর অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে। পুঁয়াপোকা যেমন নিজের শরীরকে খোলসে আবদ্ধ করে ফেলে, ভয়ের উৎপত্তি হয় যেখান থেকে মগজের সেই অংশটাকে তেমনি ভাবে বন্ধ করে দিয়ে জোসেফ হাওয়ার্ডের কেবিনের দিকে এগিয়ে চলল সে।
দরজা খুলল। পর্দা সরাল।
বিছানা আছে। তাতে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে মিস্টার হাওয়ার্ডকে। কিন্তু মিলি কই?
মিলি! ডাক দিল সে। কোথায় তুমি?
পেছন থেকে কঠোর স্বরে বলে উঠল একটা কণ্ঠ, নোড়ো না, বিলি! আমি রবিন বলছি! আমার হাতে পিস্তল আছে!
ঘুরে তাকাল বিলি। অন্ধকারে একটা পর্দার আড়ালে মানুষ আছে, অস্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে। পর্দার একটা জায়গা উঁচু হয়ে আছে। পিস্তলের নল দিয়ে ঠেলে রাখলে যেমন হয়।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার অবচেতন মনের গভীরে কোথায়। যেন কে বলে উঠল, ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু পেল না সে। ভয়ের অনুভূতিটাকে ঘিরে ফেলেছে আশ্চর্য এক খোলস। কিংবা কোন ধরনের শক্তি। হতে পারে সেটা চৌম্বক ক্ষেত্র।
অন্ধকার ছায়া থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল মিলি।
গোয়েন্দা কিংবা পিস্তলের কথা মন থেকে বেমালুম উধাও করে দিল বিলি। সেসব আর কোন গুরুত্ব বহন করে না তার কাছে। এখন তার একমাত্র আকর্ষণ মিলি।
এসো, মিলি, হাত বাড়িয়ে ডাকল সে। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে।
খবরদার, বিলি, পর্দার আড়াল থেকে ধমকে উঠল রবিন, ওকে ধরবে না!
মিলির সঙ্গে আমার কথা আছে। তাই না মিলি? ভাবছে বিলি, যদি ওর। ক্ষমতা প্রয়োগ করে মিলিকে কাছে টেনে নিয়ে আসা যেত, তাই করত।
যা বলার এখানেই বলো। কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না, আদেশ দিল। রবিন।
মিলির চোখের দিকে তাকাল বিলি। মুখটা রয়েছে ছায়ার মধ্যে। দেখা যায় না কিছু। সে চোখে কিসের খেলা চলছে বুঝতেও পারল না সেজন্যে। তুমি কি আসবে?
বললাম তো, ও তোমার সঙ্গে কোথাও যাবে না, রবিন বলল।
বাধ্য হয়ে আবার পর্দার দিকে ঘুরল বিলি। এত কাছে থেকে মাত্র ছোট্ট একটা ভাবনা দিয়েই শেষ করে দিতে পারে ওকে। চিৎকার করে শাসাল, দেখো, ইচ্ছে করলে এক্ষুণি তোমাকে খতম করে দিতে পারি আমি!
আমিও তোমার মাথায় গুলি করতে পারি। কাপড়ের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি তোমাকে। বরফের মত শীতল কণ্ঠে আদেশ দিল রবিন, তোমাকে তিন সেকেন্ড সময় দিচ্ছি বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে।…এক…
অনেক হয়েছে। চিৎকার করে উঠল বিলি। অনেক সহ্য করেছি তোমাদের জ্বালাতন! গোয়েন্দা বলে এতদিন বজ্র ছুঁড়ে মারিনি। কিন্তু ইচ্ছে করলেই পারি সেটা, বিশ্বাস করো।
দুই! গুণল রবিন।
ঠিক এই সময় বিলির সামনে চলে এল মিলি। বাধা হয়ে দাঁড়াল দুজনের সামনে।
অবাক হলো না বিলি। যেন জানত, মিলি আসবে।
থামো, রবিন! পর্দার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল মিলি। আর একটা কথাও বোলো না!
বলেই বিলির দিকে ঘুরল সে। এখন ওর চোখ দেখতে পাচ্ছে বিলি। পানি টলমল করছে সেচোখে। দেখে তার নিজের চোখেও পানি চলে এল। এই তো চেয়েছিল সে। একজনের দুঃখে আরেকজন কাঁদবে। কষ্ট পাবে। অবশেষে তাকে বুঝতে পারল মিলি। বুঝল, সে ওকে কতটা চায়।
তারপর শুনতে পেল সেই কথাটা, যেটা শোনার জন্যে গত কয়েকটা মাস অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে সে।
মিলি বলল, ঠিক আছে, আমি তোমার সঙ্গে যাব। যেখানে যেতে বলো, সেখানেই যাব। কিন্তু কারও কোন ক্ষতি কোরো না, প্লীজ!
করব না, কথা দিল বিলি। তুমি যা বলবে তাই করব আমি, মিলি।
মনে হতে লাগল ওর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত এটা।
কিন্তু বাদ সাধল রবিন। বলল, যা বলার এখানেই বলো, আমাদের। সামনে। এখান থেকে মিলিকে বেরোতে দেব না আমরা। আমি একা নই। মুসা আর কিশোরও আছে আমার সঙ্গে। যত শক্তিশালীই হও, তিনজনের সঙ্গে কোনমতেই পারবে না তুমি, বিলি।