হাসপাতালের সামনে গাড়িটা পুরোপুরি থামার আগেই দরজা খুলে লাফ দিয়ে নেমে গেল কিশোর। দৌড় দিল লিফটের দিকে। ঘন ঘন চাপ দিচ্ছে বোতামে। এলিভেটর, মুসা এবং রবিন তার কাছে একসঙ্গে পৌঁছল।
পাঁচ তলায় উঠে এলিভেটরের দরজা ফাঁক হওয়া শুরু করতেই বেরিয়ে পড়ল কিশোর।
হলে ডিউটিরত বিস্মিত নার্সকে বলল, জলদি সিকিউরিটিকে ফোন করুন। বলে দিন, হাসপাতালের পরিচিত লোক ছাড়া আর কাউকে যেন ঢুকতে না দেয়।
নার্স কি বলে না বলে তার জন্যে দাঁড়িয়ে রইল না সে। দৌড় দিল হাওয়ার্ডের কেবিনের দিকে। জানালা দিয়েই মিলিকে দেখতে পেল। অস্থিরতা নেই। বসে আছে বাবার বিছানার পাশে চেয়ারে।
ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলল দরজা। আস্তে করে ডাকল, মিলি!
ফিরে তাকাল মিলি। সতর্ক হয়ে গেছে মুহূর্তে। উঠে এগিয়ে এল। কি?
আমাদের সঙ্গে এখুনি যেতে হবে তোমাকে।
কোথায়? কেন?
হাজত থেকে বিলিকে ছেড়ে দিয়েছেন শেরিফ।
তাই নাকি! যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল মিলি। কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল মুসা আর রবিনের দিকে। কিন্তু তোমরা আমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছিলে। বলেছ আমরা নিরাপদ।
বলেছি। হাতে সময় কম। জলদি এসো। যেতে যেতে বলব…
মাথা নাড়ল মিলি। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন বাবাকে নাড়াচাড়া করা একদম উচিত হবে না। ওঁকে একা ফেলে যেতে পারব না আমি।
কিশোরের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল মুসা। আমি তোমার বাবাকে পাহারা দিচ্ছি। তুমি ওদের সঙ্গে চলে যাও।
না! আমি যাব না!
জেদ কোরো না, মিলি!
বললাম তো আমি যাব না! টেবিলে রাখা হাতব্যাগটা নিয়ে এল মিলি। খুলে একটা পিস্তল বের করে দেখাল। বাবার। নিশানা খুব একটা খারাপ না। আমার। বাবাই গুলি চালানো শিখিয়েছে।
ওরকম হাজারটা পিস্তল দিয়েও বিলির বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। ভয়ঙ্কর ক্ষমতা ওর। যত তাড়াতাড়িই করো, পিস্তল তুলে গুলি করতে যেটুকু সময় লাগবে তোমার, ওর ততটা লাগবে না। মনে মনে শুধু বলবে
দপ করে নিভে গেল বাতি। কয়েক সেকেন্ড পরেই জ্বলে উঠল আবার। চালু হয়ে গেছে হাসপাতালের স্বয়ংক্রিয় জেনারেটর। ইমারজেন্সি পাওয়ার।
থাবা দিয়ে মিলির হাতের পিস্তলটা প্রায় কেড়ে নিল কিশোর। ও এসে গেছে!
*
হলের অনেক নিচে টুং করে মৃদু একটা শব্দ হলো। মিলি, কিশোর, রবিন, মুসা, সবাই শুনতে পেল সেটা। গলা লম্বা করে কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল মুসা। শব্দটা কিসের বুঝতে চায়।
হল আর বেশির ভাগ জায়গাতেই ডিম লাইট জ্বলছে। সবচেয়ে বেশি। আলো আছে করিডরে, এলিভেটরের কাছে।
উঠে আসছে এলিভেটর।
সেদিকে দৌড় দিল তিনজনে।
টুং!
চারতলায় থেমেছে এলিভেটর। ঠিক ওদের নিচে। এলিভেটরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুহাতে পিস্তলটা চেপে ধরে সামনে বাড়াল কিশোর। বিলির। দিক থেকে কোন রকম ক্ষতির সম্ভাবনা দেখলে নির্দ্বিধায় গুলি চালাবে। তারপর যা হয় হোক।
টুং!
পাঁচতলায় থামল এলিভেটর। দরজার দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে কিশোর। উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে স্নায়ুগুলো। ট্রিগার ছুঁয়ে থাকা আঙুলটা চেপে বসতে প্রস্তুত।
খুলে যাচ্ছে দরজা। এলিভেটরের মেঝেতে দলামোচড়া হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ।
পিস্তল নামাল কিশোর। পড়ে থাকা মানুষটাকে চিনতে পারল। ভিডিও আর্কেডের সেই ছেলেটা। পটেটো।
রবিনের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করে ইশারা করল সে। বুঝতে পারল রবিন। এলিভেটরে ঢুকে পটেটোর গলার কাছে হাত দিয়ে নাড়ী দেখল। মনে পড়ল, হাজতে বসে ওর কথা জিজ্ঞেস করেছিল বিলি। ইস্, তখন গুরুত্ব। দেয়নি! দেয়া উচিত ছিল। এখন দেরি হয়ে গেছে অনেক।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল রবিন, নেই!
এলিভেটরে ঢুকে স্টপ সুইচটা টিপে দিল কিলোর যাতে ওই তলাতেই আটকে থাকে ওটা। বেরিয়ে এল আবার।
পেছনে এসে দাঁড়াল ডিউটি-নার্স। এলিভেটরের দেহটা দেখে অস্ফুট গলায় বলে উঠল, ও, লর্ড!
ওর দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। এই তলায় ওঠার আর কোন উপায় আছে?
হাত তুলে হলের শেষ মাথা দেখাল নার্স। সিঁড়ি। নিজেকে সামালানোর চেষ্টা করছে এখনও।
দুই সহকারীর দিকে ফিরল কিশোর। মিলির কাছে থাকো। ওদের পাহারা দাও।
তুমি কোথায় যাচ্ছ? জানতে চাইল মুসা।
বিলিকে ধরতে। পটেটোর লাশটা এদিকে পাঠিয়ে আমাদের নজর সরিয়ে রাখতে চাইছে সে। সেই সুযোগে… কথা শেষ না করেই সিঁড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল কিশোর।
*
সিঁড়িঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। চোখে আলো সয়ে আসার অপেক্ষা করল। মেইন লাইন থেকে বিদ্যুৎ না পাওয়ায় এখানে বেশি পাওয়ারের আলোগুলোর কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে নিভে আছে। জ্বলছে অতি সামান্য পাওয়ারের লাল বাল্ব। বিচিত্র এক অপার্থিব লালচে আলো সৃষ্টি করেছে। সরাসরি যেসব জায়গায় আলো পড়ছে না সেই কোণগুলোতে ছায়া।
আস্তে করে গলা বাড়িয়ে কোণের দিকে তাকাল সে। সিঁড়ির ধাপ দেখল।
কেউ নেই।
যতটা সম্ভব নিঃশব্দে নামতে শুরু করল সে। ধাতব সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত এবং শব্দ না করে নামা খুব কঠিন কাজ।
হাত লম্বা করে পিস্তলটা সামনে বাড়িয়ে রেখেছে।
মোড় ঘুরল একটা। কাউকে দেখা গেল না।
বাকি ধাপ কটা দৌড়ে পেরোতে শুরু করল। নিচে প্রায় পৌঁছে গেছে। এই সময় একটা গুঞ্জন কানে এল। কোন ইলেকট্রিক্যাল কয়েল খারাপ থাকলে যেমন মৃদু একটা শব্দ ওঠে, তেমনি। মাঝে মাঝে চড়চড় ফড়ফড় করে উঠছে। বাকি কয়েকটা ধাপ নিঃশব্দে নেমে কান পাতল সে।