মুখ খুলেও আবার বন্ধ করে ফেললেন শেরিফ। প্রশ্নটা করে ওকে কোণঠাসা করে দিয়েছে রবিন। জবাব খুঁজে পাচ্ছেন না।
দৌড়ে ফিরে এল কিশোর। দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে রবিনকে জানাল, মিলি বাড়িতে নেই!
নিশ্চয় হাসপাতালে রওনা হয়ে গেছে, বলেই দরজার দিকে ছুটল রবিন।
বেরিয়ে গেল দুজনে।
পেছনে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন শেরিফ। ভীষণ একটা সমস্যায় ফেলে দিয়েছে তাকে ছেলেগুলো।
১৩.
রাত বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। ভাল লাগছে না পটেটোর। বিলি ফক্স আর তার ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক খেলার ভাবনা কিছুতেই দূর করতে পারছে না। মন থেকে। মাঝেমধ্যে একআধটু উত্তেজক বিকৃত খেলা যে ভাল লাগে না। তার, তা নয়। তবে ইদানীং বড় বেশি বিকৃত খেলা শুরু করে দিয়েছে বিলি, যেটা তার সহ্যের বাইরে। এসব খেলার কথা ভাবতেও ভাল লাগছে না আর ওর।
খালি ঘর। খানিক আগে একটা ছেলে আর তার বান্ধবী এককোণে দুটো মেশিনে খেলছিল। ওরাই আজকের শেষ খেলোয়াড়। চলে গেছে। একা একা বসে এখন কমিক পড়ার চেষ্টা করছে পটেটো। মন বসাতে পারছে না।
ঠিক বারোটায় উঠে গিয়ে মেইন ব্রেকার অফ করে আলো নিভিয়ে দিল সে।
অন্ধকার হয়ে গেল আর্কেড়। তবে পুরোপুরি নয়। একধারে একটা আলো জ্বলেই রইল। ভিডিও গেম মেশিনের স্ক্রীনের আলো। সতর্ক ভঙ্গিতে পা টিপে টিপে সেটার দিকে এগোল সে। Virtual Massacre-II মেশিনটা চলছে বিদ্যুৎ ছাড়াই। পর্দায় ফাইটারদের ওপরে ফুটে উঠেছে নামের একটা স্তম্ভ। বিশটা নাম। সবগুলো একজনের-বি, পিএফ.।
এই, যাহ! লেখাগুলোকে বলল সে। যেন ধমক দিলেই কথা শুনবে মেশিন। অপেক্ষা করতে লাগল মেশিন বন্ধ হওয়ার। হলো না। বিড়বিড় করে বলল, বিলি, আমি জানি, তুমি একাজ করছ।
জবাব নেই।
হঠাৎ ঝমঝম করে বেজে উঠল জুকবক্সটা। দি নাইটওয়াকারস।
ঘটনাটা নতুন নয় পটেটোর কাছে। কিন্তু এ মুহূর্তে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সে। জোর করে হাসল।
কি হয়েছে বিলি? কিছু বলতে চাও? দরজার দিকে পা বাড়াল পটেটো। আতঙ্ক চেপে রাখার চেষ্টা করছে। ওর চারপাশের বাতাস ঘন, ভারী হয়ে। উঠেছে। অদ্ভুত এক ধরনের গন্ধ। বিদ্যুৎ-ঝড়ের পর যেমন হয়।
প্রতিটি পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে আরও বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে। এ এক ভয়ানক পরিস্থিতি। আতঙ্ক কিছুতেই বাগ মানাতে পারছে না। একটা মানুষখেকো হাঙরের সঙ্গে সাঁতার কাটছে যেন। জানে নিচের গভীর পানিতে কোনখানে রয়েছে ওটা, কিন্তু ও দেখতে পাচ্ছে না। সময়মত ঠিকই ভুস করে উঠে আসবে ওকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে।
দরজা খোলার জন্যে ঠেলা দিল পটেটো। পকেট থেকে চাবির গোছা বের করল। আবছা আলোয় অনেকটা আঙুলের আন্দাজে খুঁজে বের করল সঠিক চাবিটা। হাত ভীষণ কাঁপছে।
চিৎকার করে উঠল সে, কি করছ? বলেছিই তো ওদের কিছু বলিনি আমি!
জুকবক্সে মিউজিকের কানফাটা ঝমঝম ছাড়া কেউ জবাব দিল না তার কথার।
বাইরে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে কাঁপা হাতে কোনমতে চাবিটা তালায় ঢোকাল সে। তালা লাগানোর পর একটা মুহূর্ত আর দেরি করল না। ছুটে নামল চত্বরে। ঝোড়ো বাতাস বইছে।
পার্কিং লটে এসেও শব্দের অত্যাচার থেকে নিস্তার পেল না। এখন বাজনা বাজাচ্ছে বাতাসের শব্দ। গাছগুলোও যেন স্পীকারে পরিণত হয়েছে। আকাশে মেঘ গুমগুম করে বাজিয়ে চলেছে হেভি মেটাল মিউজিক।
ওকে ঘিরে বইছে প্রবল বাতাসের ঘূর্ণি। এখনও দেখতে পাচ্ছে না বিলিকে। চিৎকার করে বলল, বিলি, বিশ্বাস করো! আমি কিছু বলিনি ওদের! শিশুর মত অসহায় ভঙ্গিতে কেঁদে উঠল। আমি তোমার বন্ধু, বিলি! আমার সঙ্গে এমন করছ কেন?
এতক্ষণে জবাব মিলল। মিউজিকের চেয়ে জোরাল শব্দে, রোদের চেয়ে উজ্জ্বল বিদ্যুতের একটা হলকা এসে লাগল ওর পিঠে। হৃৎপিণ্ডটাকে পুড়িয়ে দিয়ে বুক ভেদ করে গিয়ে ঢুকে গেল মাটিতে।
মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পটেটো। পকেট থেকে সিকিগুলো ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। পার্কিং লটে কংক্রীটের মেঝেতে ঝনঝন শব্দ তুলল। কিছুই কানে ঢুকল না তার। ঢুকবেও না আর কোনদিন।
*
আর্কেডের হাতে দাঁড়িয়ে পার্কিং লটে পড়ে থাকা ওর বন্ধুর দেহটার দিকে তাকিয়ে আছে বিলি। মনের মধ্যে খুঁজে দেখল, যে কাজটা করেছে তার জন্যে কোন রকম দুঃখবোধ, অনুশোচনা আছে কিনা। নেই। একটুও খারাপ লাগছে না। ভয়বাহ বিদ্যুৎ যেন তার ভেতরটাকেও পুড়িয়ে, মুছে অনুভূতি আর আবেগশূন্য করে দিয়েছে। যা ঘটানোর ঘটিয়ে ফেলেছে। ফেরার উপায় নেই আর। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়া। যা শুরু করেছে সেটার শেষ করতেই হবে।
ভয় পায় না সে। মিলি যদি সঙ্গে থাকে দুনিয়া জয় করার চেষ্টাতেও আপত্তি নেই।
সব পারবে।
প্রবল বেগে বাতাস বইছে। উত্তরের আকাশে মেঘ জমছে। ঝড় আসবে।
দেখেও দেখল না বিলি। কেয়ারও করল না। ঝড়বৃষ্টি দেখার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী কাজ এখন পড়ে আছে তার সামনে। ছাত থেকে নেমে আসতে লাগল পটেটোর লাশটা তুলে নেয়ার জন্যে।
.
১৪.
হাসপাতালে যাওয়ার সময় সারাটা পথ আরও জোরে গাড়ি চালানোর জন্যে মুসাকে তাগাদা দিতে থাকল কিশোর। পঞ্চাশ-ষাট মাইল বেগে চলছে, তা-ও মনে হচ্ছে ওর, অনড় হয়ে আছে গাড়িটা।
মিলিকে কথা দিয়েছে, সে আর তার বাবা নিরাপদে থাকবেন। রাখার দায়িত্ব ওদের। বাঁচাতে না পারলে মিলির কাছে ছোট হয়ে যাবে তিন গোয়েন্দা। মান থাকবে না শেরিফ রবার্টসনের কাছে।