*
মাটিতে পড়ে থেকে ধীরে ধীরে লম্বা দম নিল বিলি ফক্স। রাগ কমানোর জন্যে নয়, বরং বাড়ানোর জন্যে। আর্কেড় এখন অন্ধকার। পার্কিং লটের বৃষ্টিভেজা। বাতিটা থেকে মলিন আলোর আভা এসে পড়েছে ঘরে।–
ক্যাপটা কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। শান্ত ভঙ্গিতে মাথায় পরল আবার। আগুন জ্বলছে মনে। কিন্তু প্রকাশ পেতে দিচ্ছে না। উত্তেজিত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর চেয়ে এভাবে আস্তে আস্তে খেলে যাওয়ার মজা অনেক বেশি।
কোণের জুকবক্সটা গমগম করে বেজে উঠল হঠাৎ। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, তা ও বাজছে। কোথা থেকে শক্তি পেল ওটা বুঝতে পারল না লেসলি। দি নাইটওয়াকার বাজতে লাগল কানফাটা শব্দে। গানটা যে বিলির প্রিয় গান, তা-ও জানা নেই ওর।
লেসলির কাছে সরে এল বিলি। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমার দান তুমি খেলেছ। এবার আমার পালা।
বিলির কণ্ঠে এমন কিছু রয়েছে, অস্বস্তি বোধ করতে লাগল লেসলি। আর লাগার সাহস পেল না। পিছিয়ে এল। হ্যাঁ, খেয়ে আর কাজ পেলাম না, তোমার সঙ্গে ফালতু সময় করি! কণ্ঠের সেই একটু আগের জোরটাও নেই আর।
দরজার দিকে রওনা দিল সে।
*
পার্কিং লটের খোলা বাতাসে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল লেসলি। আর্কেডের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না সেসময়মত বিদ্যুৎ চলে যাওয়া, বিদ্যুৎ ছাড়াই জুকবক্স বেজে ওঠা। কৌতূহল থাকলেও সাহস দেখাতে পারল না। বরং তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাওয়ার একটা প্রবল ইচ্ছে তাগাদা দিচ্ছে মনে।
গাড়িতে উঠে ইগনিশনে মোচড় দিল সে। ফুল ভলিউমে বেজে উঠল রেডিও। গানটা পরিচিত। অতি পরিচিত।
দি নাইটওয়াকার!
আর্কেডের জুকবক্সে এই গানই বাজছিল।
ও কিছু না! সেফ কাকতালীয়! মন থেকে ভয় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। মোচড় দিয়ে অফ করে দিল রেডিওর সুইচ।
কিন্তু বেজেই চলল গান।
অসম্ভব! এ হতেই পারে না! নব ঘুরিয়ে কাটাটা পার করে দিল ডজনখানেক স্টেশন।
গান বন্ধ হলো না।
ফিরে তাকিয়ে দেখল আর্কেডের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে হাড্ডিসার ছেলেটা। শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে এদিকে।
ফার্স্ট গিয়ার দিল লেসলি। অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরল। ভেজা চত্বরে পিছলে গেল চাকা। তারপর এগোতে শুরু করল।
মনে পড়ল, কিছুদিন থেকে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটছে এই ছোট্ট শহরটাতে। রহস্যময়ভাবে মারা যাচ্ছে মানুষ। চৌরাস্তায় পর পর কতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোও রহস্যময়। যারা ভূত বিশ্বাস করে, তাদের কেউ কেউ বলছে ভূতের উপদ্রব।
আর্কেডের ঘটনাটাও ভূতুড়ে মনে হচ্ছে লেসলির কাছে। বিদ্যুৎ ছাড়া যন্ত্র বাজে কিভাবে? বুঝে গেছে, আর্কেডের দরজায় দাঁড়ানো ওই ছেলেটার সঙ্গে এসবের নিশ্চয় কোন সম্পর্ক রয়েছে। অতএব পালাতে হবে ওর কাছ থেকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
গেটের কাছে এসে বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন। মিসফায়ার করল না। পুটপুট করল না। কোন আগাম সঙ্কেত দিল না। এঞ্জিন বন্ধ হওয়ার কোন রকম নিয়ম-কানুন না মেনে স্রেফ থেমে গেল। গাড়িটাও দাঁড়িয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
মরিয়া হয়ে ইগনিশনে মোচড় দিতে লাগল লেসলি। কাজ হলো না। চালু হলো না এঞ্জিন। কোন শব্দই করল না।
রেডিওতে বেজেই চলেছে দি নাইটওয়াকার।
দরজায় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আজব ছেলেটা।
হঠাৎ আলোর বিস্ফোরণ ঘটল যেন। সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ। ঝট করে ঘুরে গেল লেসলির মুখ। গাড়ির অ্যানটেনায় লাগানো পিজ্জা ডেলিভারি সাইনটাতে আগুন লেগে গেছে। পরক্ষণে ভয়ঙ্কর এক ধাক্কা লাগল শরীরে। বুক থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ল হাত, পা, আর মাথায়। মনে হলো কোটর থেকে খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে চোখ। প্রচণ্ডভাবে মোচড় খেতে শুরু করল দেহটা। সীটের ওপর লাফাতে লাগল পানি থেকে তোলা মাছের মত। পেশীর ব্যথা অসহ্য।
বুঝে নিল লেসলি, এই পার্কিং লট থেকে জীবন্ত বেরোতে পারবে না সে। মুঠো হয়ে গেল হাতের আঙুল। ওগুলোর মাথা থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে বিদ্যুৎ-ফুলিঙ্গ। কোনমতে হাত বাড়িয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করল সে। এত বেশি হাত কাঁপছে, হাতলটাই ধরতে পারল না। কাঁপুনির চোটে মাথাটা গিয়ে বাড়ি খেল দরজার পাশে।
কিন্তু কিছুই করার নেই আর ওর!
কিছুই করার নেই মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া!
*
আর্কেডের দরজায়-দাঁড়িয়ে লেসলিকে মারা যেতে দেখল বিলি। কোন রকম আবেগ তৈরি হলো না তার মনে। করুণা জাগল না।
অবশেষে গাড়ির রেডিও থেকে তার মনো-আকর্ষণ সরিয়ে আনল সে। চুপ হয়ে গেল রেডিও। নীরব হলো পার্কিং লট। কনভার্টিবলের সামনের সীট থেকে একঝলক পোড়া ধোয়া বেরিয়ে উঠে গেল স্ট্রীট ল্যাম্পের আলোর দিকে।
এতক্ষণে ঘুরে দাঁড়াল বিলি। ঢুকে গেল আবার আর্কেডের ভেতর।
পেছনে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে পটেটো। বিলি তাকাতেই হেসে একটা কয়েন বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।
কিন্তু নিল না বিলি। গেম মেশিন চালু করতে ওটার আর প্রয়োজন নেই। যে-কোন বৈদ্যুতিক যন্ত্র এখন তার গোলাম। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সার্কিটে ঢোকার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে ওর মনের। বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সামর্থ্য আছে।
ভুরু থেকে এক ফোঁটা ঘাম মুছে ফেলে মেশিনের সামনে এসে দাঁড়াল সে। তাকাল শুধু ওটার দিকে। তাতেই যেন জাদুমন্ত্রের বলে আপনাআপনি চালু হয়ে গেল মেশিন।
মুখের একটা পেশী কাঁপাল বিলি। মুহূর্তে শুরু হয়ে গেল নতুন খেলা। কয়েন ফেলার পর যেমন করে হয়।