থাক, ওসব স্মৃতিচারণ করে আর লাভ নেই এখন, বাধা দিল রবিন। ভাবলেও রাগ লাগতে থাকে। বরং ড্যানির ব্যাপারটা নিয়ে কি করা যায় তাই বলো।
যদি মনে করো, ক্লডিয়া বলল, তত্ত্বাবধায়কের কথা না শুনলে সত্যি সে কোন অঘটন ঘটাবে, তাহলে পুলিশের কাছে যাওয়াই ভাল।
ঘটায় কিনা সেটা দেখলে কেমন হয়? প্রস্তাবটা ড্যানিই দিল।
সত্যি দেখতে চাও?
চাই বলাটা ভুল হবে। হুকুম যা দিচ্ছে তাতে তো পরিষ্কার সে একটা উন্মাদ। কোন সুস্থ লোক এসব করার কথা বলতে পারত না। কাপুরুষ বলো আর যা-ই বলো, কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে যাওয়াই উচিত এখন। আমার, তত্ত্বাবধায়কের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কোথায় গেছি জানতেও পারবে না সে, ক্ষতিও করতে পারবে না।
.
০৬.
পুরানো প্রিয় জায়গায় ফিরে যেতে ভাল লাগে মানুষের। বিশেষ করে সেই জায়গাটা যদি কোন কারণে তার কাছে নিষিদ্ধ হয়ে যায় তাহলে আকর্ষণ যেন আরও বেড়ে যায়। রকি বীচে ফিরে অনির্দিষ্টভাবে ঘোরাঘুরি করতে করতে কখন যে স্কুলের স্টেডিয়ামের কাছে চলে এল মুসা, নিজেও বলতে পারবে না। বাইরে গাড়ি রেখে মাঠে ঢুকল। বাস্কেটবল খেলতে তাকে আপাতত বারণ করে দিয়েছেন ডাক্তার। তবে এটাও বলেছেন, মেরুদণ্ড ব্যথা করলেও হালকা ব্যায়ামে কোন অসুবিধে হবে না। ভাল দৌড়াতে পারে সে। মানে, পারত। কোয়ার্টার মাইল আর হাফমাইলে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এখনও কি শরীরের সে-ক্ষমতা অটুট আছে?
শার্ট-প্যান্ট-জুতো খুলে রেখে শুধু আন্ডারওয়্যার পরে মাঠের একধার থেকে দৌড়ানো শুরু করল সে। প্রথমে খুব ধীরে। গতি বাড়তে লাগল। ছন্দময় পদক্ষেপ। দেখতে দেখতে গতি উঠে গেল অনেক।
জোরে জোরে দম ফেলছে। কিন্তু পরিশ্রম লাগছে না। বাহ্, ভালই তো পারছে। যেন মুক্তির আনন্দ। ডানাভাঙা পাখির ডানা ফিরে পাওয়ার মত। মন থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় হয়ে যাচ্ছে সমস্ত দুশ্চিন্তা। বিষণ্ণতা কেটে যাচ্ছে।
এক মাইল দৌড়াল সে-দুই মাইল:-তিন-চার…
থামল যখন, দেহের প্রতিটি পেশি অবশ হয়ে গেছে। ঘামছে দরদর করে। হেঁটে চলে এল মাঠের ধারে একটা গাছের নিচে। সবুজ ঘাসে শুয়ে পড়ল চিত হয়ে। আকাশ দেখতে পাচ্ছে। নীল, পরিষ্কার আকাশ। মন উড়ে গেল যেন সুদূর মহাশূন্যে। ভেসে বেড়াতে লাগল শরীরটা।
ঘুম ভাঙলে দেখল আকাশের নীল রঙ ধূসর হয়ে গেছে। ঝলমলে রোদ হারিয়ে গেছে বহু আগে। তারা ফুটবে এখনই। অন্ধকারের দেরি নেই। কি কাণ্ড! সারাটা দিন গাছের নিচে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল, অথচ মনে হচ্ছে এই তো মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে শুয়েছে।
উঠে বসল। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। ব্যথা করছে সর্বাঙ্গ। এত ঘুমিয়েও ঝরঝরে হয়নি। তবে দুশ্চিন্তা করল না সে। ব্যায়ামে দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে আবার হঠাৎ শুরু করলে এরকমই হয়। হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এল কাপড়গুলো যেখানে ফেলে গিয়েছিল সেখানে। পরে নিল। ধীরেসুস্থে করছে সবকিছু। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। দিনটা.তো কাটাল। এখন কি করবে? যাবে কোথায়? বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ভাবতে ভাবতে চলে এল। গাড়ির কাছে।
স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে উঠে বসল। পা দুটো আড়ষ্ট লাগছে। মাথা ধরেছে। গাড়িতে ওষুধের শিশি আছে। ব্যথা পাওয়ার পর থেকে টাইলিনল ট্যাবলেট রাখে সঙ্গে। শিশিটা বের করে দুটো ট্যাবলেট নিয়ে মুখে পুরল। চিবিয়ে গুড়ো করে পানি ছাড়াই গিলে ফেলল তেতো ওষুধ। শিশিটা আবার রাখতে গিয়ে হাতে ঠেকল একটা কাগজের টুকরো। ফেলে দেয়ার জন্যে বের করে আনল। স্ট্রীটল্যাম্পের হ্যালোজেন লাইটের আলোয় লেখার ওপর চোখ পড়তেই কাগজধরা আঙুল দুটো শক্ত হয়ে গেল। ক্রিসি ট্রেভারের ঠিকানা আর ফোন নম্বর।
ঘড়ি দেখল। মোটে সাতটা বাজে। কানে বেজে উঠল ক্রিসির কণ্ঠ: বিকেলের পর আর বেরোই না আমি। তোমার ম্যাসাজ দরকার হলে ওই সময়টায় এসো।
কিন্তু আজ শনিবার। ওর মত অল্পবয়েসী একজন মহিলা কি ছুটির সন্ধ্যায় ঘরে বসে থাকবে? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে না যাক, সিনেমায়ও তো চলে যেতে পারে? যাওয়ার আগে ফোন করে নেয়া দরকার।
গাড়ি চালিয়ে সবচেয়ে কাছের ফোন বুদটায় এসে ক্রিসির নম্বরে ডায়াল করল সে।
তৃতীয় রিঙে ধরল ক্রিসি। বাড়িতেই আছে। হালো?
ক্রিসি? আমি মুসা।
একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল ক্রিসি। তারপর ভেসে এল তার উচ্ছল কণ্ঠ, হাই, মুসা। কেমন আছ?
ভাল। আপনি কেমন?
ভাল। একা একা ঘরে বসে অবশ্য বিরক্ত লাগছে। কি করছ?
একা একা রাস্তায় ঘুরতে আমারও ভাল লাগছে না। দিনের বেলা খুব দৌড়াদৌড়ি করেছিলাম। ব্যথা করছে।
তারমানে ম্যাসাজ লাগবে? হাসল ক্রিসি। নো প্রব্লেম। চলে এসো।
যে মলে ওদের দেখা হয়েছিল তার কাছাকাছিই একটা নতুন অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকে ক্রিসি। মুসা বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল। কালো প্যান্ট আর সাদা ব্লাউজ পরেছে। নার্সের সাদা পোশাকের চেয়ে এই কাপড়ে অনেক বেশি সুন্দরী লাগছে ওকে। সবুজ চোখে উজ্জ্বলতা। লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটে আন্তরিক হাসি।
এসো, ভেতরে এসো, দরজা থেকে সরে জায়গা করে দিল ক্রিসি। নোংরা করে রেখেছি। কিছু মনে কোরো না।
ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখল মুসা। নোংরাটা কোথায় বুঝতে পারল না। কেবল একটা কফি-টেবিলে পড়ে থাকা দুটো পেপারব্যাক বইয়ের পাশে রাখা একটা কফির পট আর একটা মগে আধমগ কফি ছাড়া। ঘরের সমস্ত আসবাব বেশ উঁচু মানের। ক্রিসির বাবা-মা মনে হয় খুব ধনী। টাকা দিয়ে তারাই বোধহয় সাহায্য করে। হাসপাতালে নার্সের চাকরি করে এত বিলাসিতায় বাস করা সম্ভব নয়।