তরুণ অফিসার। সুন্দর করে ছাঁটা বাদামী গোফ। নীল ইউনিফর্ম চমৎকার ফিট করেছে। গাড়ি ঘেষে দাঁড়িয়ে রবিনের দিকে তাকাল। ডাক্তারের মত ভাবলেশহীন মুখ নয়। অন্তত খানিকটা অনুভূতি এর আছে।
হ্যাঁ, গিয়েছিলাম, রবিনের বাহু স্পর্শ করল অফিসার। তোমার বন্ধুর জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। এত অল্প বয়েসেই শেষ হয়ে গেল বেচারি।
কিভাবে অ্যাক্সিডেন্ট করল?,
গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়েছিল। রাস্তার ধারের একটা অলিভ গাছ। এমন গুতেই মেরেছে, গাছটাও শেষ, গাড়িটাও ভর্তা।
ব্রেক ফেল করেছিল নাকি? না চাকা পিছলে গিয়েছিল?
কোনটাই না। চাকা পিছলালে ব্রেক করত। তাতে স্কিড মার্ক থাকত। ওরকম কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। নেশার ঘোরে থাকলে কিংবা ঘুম পেলে অনেক সময় স্টিয়ারিঙে হাত ঠিক থাকে না। তীব্র গতির সময় স্টিয়ারিং সামান্য ঘুরলেও গাড়ি অনেক সরে যায়। রাস্তায় সামান্য পরে পরেই গাছ। গুতে লাগিয়েছে বোধহয় ওসব কোন কারণেই। গাড়ির অবস্থা দেখে মনে হয় ষাট মাইল বেগে ছুটছিল।
ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেছে?
পায়ের ভার বদল করল অফিসার। অস্বস্তি বোধ করছে। কোন সন্দেহ নেই তাতে।
এত শিওর হচ্ছেন কি করে?
শুনলে ভাল লাগবে না তোমাদের।
গোলাপী কাগজে লেখা চিঠিটা মনের পর্দায় ভেসে উঠল রবিনের। তবু, বলুন।
মুখ নিচু করল অফিসার। দেখো, সত্যি ভাল লাগবে না।
আমি জানতে চাই।
জানালা ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল ওর মাথা। গাছের ডালে গলা টান লেগে ঘাড় ভেঙেছে। প্রচণ্ড ঝাড়া লেগে…
বলুন? কি হয়েছিল প্রচণ্ড ঝাড়া লেগে?
গাল চুলকাল অফিসার। দেখো, অ্যাক্সিডেন্টে মানুষ মারা গেলে লাশের চেহারা আর চেহারা থাকে না। তার ওপর যদি ধড় থেকে গলা ছিঁড়ে গিয়ে মাথাটা…
আর সহ্য করতে পারল না মুসা। কপাল টিপে ধরল।
রবিনও কাঁপতে শুরু করেছে।
আগেই বলেছিলাম তোমাদের, সহ্য করতে পারবে না, অফিসার বলল। বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার পাশের একটা ঝোপে পাওয়া গেছে ওর মাথাটা।
০৫.
ব্ল্যাক ফরেস্ট পার্কে বসে আছে ওরা। পার্কটা শহরের একধারে, হাই স্কুলের পেছনে। পাশ দিয়ে বইছে গ্রে উইলো রিভার। নির্জন পার্ক। বিমর্ষ, গভীর পরিবেশ।
ক্লডিয়াও এখন আছে ওদের সঙ্গে। পর্বত থেকে ফিরেছে। সেদিন সকালের ডাকে একটা চিঠি পেয়েছে ড্যানিয়েল। সোফির চিঠিটার হুবহু নকল। তফাত কেবল নামের সারিতে ওপরের নাম অর্থাৎ সোফির নাম নেই। সাঙ্কেতিক একটা বিজ্ঞপ্তিও ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। লিখেছে:
ছোট বোনের ডান হাত পুড়িয়ে দাও
কে ডেকেছে এই মীটিং? জানতে চাইল রবিন। ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছে। তার পাশে বসে একটা ঘাসের ডগা দাঁতে কাটছে মারলা। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। খবরটা শোনার পর থেকে কারোরই মন-মেজাজ ভাল নেই।
মীটিং ডাকিনি, ক্লডিয়া বলল। সবাইকে একজায়গায় হতে বলেছি যার যা ইচ্ছে বলার জন্যে।
লাভটা কি তাতে?
যদি কোন সমাধান বেরিয়ে আসে।
ভাল কথা, রবিন বলল। তাহলে বসে আছ কেন সবাই চুপচাপ?
বুঝতে পারছি না কিভাবে শুরু করব। আজকে আর উগ্র পোশাক পরেনি ক্লডিয়া, সাধারণত যেমন পরে থাকে সে। খাটো করে ছাঁটা তুষারশুভ্র চুল। চুলের রঙ আর শার্টের রঙ এক। পরনে নীল জিনস। ঠোঁটে লিপস্টিক আছে, তবে খুবই পাতলা করে লাগানো। মেকআপ নেয়নি বললেই চলে। ওর এই মেকআপ নিয়ে মারলা তো প্রায়ই ইয়ার্কি মেরে বলে এক কেজি পাউডার আর আধা কেজি লিপস্টিক না হলে ক্লডিয়ার মেকআপই হয় না। আজ সেসব প্রায় কিছুই নেই।
নড়েচড়ে বসল ড্যানি, এরপর আমার পালা। চিঠি এবং গোটা পরিস্থিতি সম্পর্কে যা যা জানি সেটা নিয়ে প্রথমে আলোচনা করতে পারি আমরা। তারপর করতে পারি যা জানি না সেটা নিয়ে। কেমন হয়?
ভাল, নিচুস্বরে বলল মুসা। সবার কাছ থেকে সামান্য দূরে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছে। সারারাত ঘুমায়নি। এখন সকাল এগারোটা। বাজে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কথাবার্তা শেষ হলে এখানে এই ঘাসের মধ্যে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়বে।
এই চিঠি এমন কেউ লিখেছে, শুরু করল ড্যানি, যে আমাদের সবাইকে চেনে। আমাদের গোপন ব্যাপারটা সম্পর্কে জানে। প্রথমে ভেবেছিলাম রসিকতা করছে, কিংবা ফাঁকা বুলি ঝাড়ছে সে। কিন্তু সোফির খুন হওয়ার পর এখন বুঝতে পারছি সে সিরিয়াস। সোফিকে তত্ত্বাবধায়কই খুন করেছে।
কি সব ছেলেমানুষের মত কথা বলছ, ড্যানির কথায় একমত হতে পারল না ক্লডিয়া। সোফি গাড়ি চালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। পুলিশের মতে এটা নিছকই দুর্ঘটনা। রাতের বেলা এত জোরে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে।
এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত, রবিন বলল। ওর মনের যা অবস্থা হয়েছিল, তাতে অন্যমনস্ক থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল না। এর জন্যে অবশ্যই দায়ী করতে হবে তত্ত্বাবধায়ককে। তার মানে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে এই খুনের জন্যে সে-ই দায়ী।
কিন্তু বড় বেশি কাকতালীয়; মেনে নিতে পারছে না ড্যানি।
তোমার কি ধারণা অলৌকিক কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করে সোফিকে অ্যাক্সিডেন্ট করতে বাধ্য করেছে তত্ত্বাবধায়ক? হাত নাড়ল রবিন, আমি, একথা বিশ্বাস করতে রাজি না।
কিন্তু একটা কথা তো ঠিক, মারলা বলল, চিঠিতে লিখেছিল ওর কথার অবাধ্য হলে মারাত্মক পরিণতি ঘটবে। সোফি অবাধ্য হয়েছে, ওর কথামত কুকুরের বাচ্চাটাকে চুবিয়ে মারেনি, অতএব তাকে মরতে হলো। আর কি। ভয়ঙ্কর মৃত্যু! ধড় থেকে মাথাই আলাদা… কেঁপে উঠল মারলা। চোখের কোণে পানি টলমল করে উঠল। সোফির জন্যে থেকে থেকেই কাঁদছে। খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল।