.
০৪.
ওদের জন্যে বৃহস্পতিবারটা এল আর গেল কোন রকম নতুনত্ব না নিয়ে। ক্লডিয়া ফিরল না। অতএব আলোচনায় বসাও আর হলো না।
সারাদিন সাফির সঙ্গে কাটাল মারলা। মলে কেনাকাটা করল। সিনেমা দেখতে গেল। সারাটা দিন মোটামুটি শান্তই রইল সোফি। রাত বারোটা পর্যন্ত তার সঙ্গে সঙ্গে রইল মারলা। রাতেও থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু সোফি বলল লাগবে না। তার আম্মা ফিরেছেন।
সকালে ফোন করে খবর নেবে বলে বাড়ি ফিরে গেল মারলা।
কথামত পরদিন সকালে ফোন করল সে। ভালই আছে সোফি।
খবরটা সবাইকে জানিয়ে দিল মারলা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওরা। যাক, চিঠিটা আসলেই একটা ফালতু রসিকতা ছিল।
ক্লডিয়ার ফেরার অপেক্ষায় রইল সবাই। কিন্তু ফিরল না সে। মাকে ফোন করে জানিয়ে দিল আরও একদিন দেরি হবে।
শুক্রবার রাত।
সকাল সকাল শুয়ে পড়ল রবিন। মাথা ধরেছে। গত কদিন ধরে যা উত্তেজনা যাচ্ছে। শোয়র সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। নানা রকম অদ্ভুত স্বপ্ন। দেখতে লাগল। কানের কাছে দমকলের ঘন্টা শুনে যেন ঘুম ভেঙে গেল ওর। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল বিছানায়।
ফোন বাজছে। চমকে গেল। এতরাতে কে? বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করল যেন ওর। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। হালো?
রবিন?
হ্যাঁ। কে?
মিসেস হল।
ধড়াস করে এক লাফ মারল রবিনের হৃৎপিণ্ড। দম আটকে এল। সোফির কি হয়েছে? ভাল আছে ও?
ফুঁপিয়ে উঠলেন সোফির আম্মা। জানি না। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল। অ্যাক্সিডেন্ট করেছে সোফি। আমাকে এখুনি যেতে বলেছে। সোফির বাবা বাড়ি নেই। আমিও চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না। রবিন, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবে? এই অবস্থায় আমি গাড়ি চালাতে পারব না।
এতটাই অস্থির হয়ে পড়েছেন মহিলা, ভুলে গেছেন বহুদুরে থাকে রবিন। গাড়িতে করে যেতেও অন্তত একটি ঘণ্টা লাগবে ওর।
নিশ্চয় পারব, বলল রবিন, তবে আমার আসতে তো অনেক সময় লেগে যাবে। তারচেয়ে মুসাকে ফোন করে দিচ্ছি, সে আপনার অনেক কাছাকাছি থাকে। আমিও আসছি। হাসপাতালে দেখা হবে।
আচ্ছা, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন মিসেস হল। মেয়ে কেমন আছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম। কোন জবাব দিল না হাসপাতাল থেকে। ও মরে যায়নি তো?
না, মিসেস হল। সোফির অবস্থা সম্পর্কে এখনও শিওর না হয়তো ওরা। সেজন্যেই কিছু জানাতে পারেনি। ভাববেন না। কিছু হয়নি সোফির। কোন্ হাসপাতালে নিয়েছে?
জেনে নিয়ে মুসাকে ফোন করল রবিন।
অবাক কাণ্ড। একবার রিঙ হতেই রিসিভার তুলে নিল মুসা। যেন তৈরি হয়ে বসেছিল ফোনের কাছে। ঘুমায়নি, ওর কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারল রবিন। ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বাজে একটা। কি করছে মুসা?
মুসা?।।রবিন। খারাপ খবর আছে।
সোফির?
তুমি কি করে জানলে?
অনুমান। কি হয়েছে ওর?
মিসেস হল ফোন করেছিলেন, কি হয়েছে মুসাকে জানাল রবিন।
দশ মিনিটের মধ্যেই চলে যাচ্ছি আমি।
তুমি খারাপ খবর শোনার জন্যে বসে ছিলে, তাই না? ঘুমাওনি কেন?
ঘুম আসছিল না।
কি মনে হয়, মুসা? সোফি কি মারা গেছে?
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। জানি না! আজকাল আর কোন কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না…অ্যাক্সিডেন্টটার পর থেকে কোন কিছু বেশি। ভাবলেই মাথা ধরে…
আমারও!
.
সোফি মারা গেছে!
খবরটা একই সঙ্গে শুনল ওরা তিনজন। রবিনদের গোস্ট লেনের বাড়ি থেকে হাসপাতাল অনেক দূর। তবু মুসার গাড়িটা যখন হাসপাতালের পার্কিং লটে ঢুকল, তার মিনিটখানেক পর রবিনও ঢুকল। মুসা ঠিকমতই সোফিদের বাড়িতে পৌঁছেছিল। কিন্তু প্রচণ্ড অস্থিরতার কারণে নানা রকম অঘটন ঘটিয়ে বেরোতে দেরি করে ফেলেছেন মিসেস হল।–
হাসপাতালে মেয়ের খবর শুনে বেহুশ হয়ে গেলেন তিনি। তাড়াতাড়ি নার্সরা ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল তাকে। রবিনের মাথা ঘুরছে। যে ডাক্তার ওদের খবরটা দিলেন, বলার ভঙ্গিতে মনে হলো মৃত্যু নয়, সাধারণ সর্দি লাগার খবর দিচ্ছেন যেন। মাঝবয়েসী ভদ্রলোক, সবুজ সার্জিক্যাল গাউনে রক্ত লেগে আছে। ইমার্জেন্সি রূমে ডিউটি করেন। সারাক্ষণ জখমী রোগী আসতেই আছে। গাড়ি দুর্ঘটনা, ছুরি মারামারি, গুলিতে আহত রোগী, আসে বিরামহীনভাবে। এত দেখতে দেখতে ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছে ডাক্তারের। মৃত্যু আর কোন প্রতিক্রিয়া করে না তার মনে। কাউকে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর শোনাতে বিন্দুমাত্র মুখে আটকায় না আর।
অ্যাক্সিডেন্টটা হলো কিভাবে? হাঁটু কাঁপছে রবিনের। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।
মাথা নেড়ে বললেন ডাক্তার, শুনিনি। পুলিশকে জিজ্ঞেস করে দেখো।
বোকার মত প্রশ্ন করে বসল রবিন, সত্যি মারা গেছে, নাকি ভুল হয়েছে। আপনাদের? মানে, আমি বলতে চাইছি এখনও কোন সম্ভাবনাঃ…ভালমত চেষ্টা করলে এখনও হয়তো বাঁচানো যায়…
শূন্য দৃষ্টি ফুটল ডাক্তারের চোখে। হাসপাতালে আনার অনেক আগেই মরে গেছে। হাত ছোঁয়ানোরও সুযোগ পাইনি আমরা।
পুলিশ চলে যাওয়ার আগেই ওদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মুসার দিকে তাকাল রবিন। মুখের যা ভঙ্গি করে রেখেছে মুসা, তাতে বোঝা যায় ওর মানসিক অবস্থাও সুবিধের না। তাকে নিয়ে পার্কিং লটে বেরিয়ে এল রবিন। যে অ্যাম্বুলেন্সে করে সোফিকে আনা হয়েছে, তার ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে একজন পুলিশ অফিসার।
এগিয়ে গেল রবিন। এক্সকিউজ মি, অফিসার, বলল সে। কার অ্যাক্সিডেন্ট করা যে মেয়েটাকে এক্ষুণি নিয়ে এলেন আপনারা, আমি তার বন্ধু। ডাক্তারের কাছে শুনলাম মারা গেছে। আপনি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন?