*
গাড়িতে বসে অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর। এত দেরি করছে কেন রবিন? নেমে গিয়ে দেখে আসার কথা যখন ভাবছে এই সময় এল সে। সব কথা জানাল। জবারের সঙ্গে দেখা করে এসেই ক্লডিয়াদের বাড়িতে যাবে, ঠিক করল ওরা। মারলার পরের নামটা ক্লডিয়ার। তত্ত্বাবধায়ক এরপর ওর নামেই মেসেজ পাঠাবে। মারলা কি করেছে সেটা জানিয়ে ক্লডিয়াকে সাবধান করে দেয়া দরকার।
গাড়ি চালাচ্ছে রবিন। পাশে চুপচাপ বসে আছে কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে।
কি ভাবছ? রবিনের চোখ সোজা সামনের দিকে। ঝলমলে জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে যেন। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। পূর্ণিমা নাকি আজ? আচ্ছা, শয়তান উপাসকরা কি পূর্ণিমাকে বেছে নেয়? নাকি অমাবস্যা?
সেটা নির্ভর করে কোন ধরনের পূজা ওরা করছে।
কিশোর, একটা কথা ভাবছি। আমাদের এই তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে ওই শয়তান উপাসকদের কোন সম্পর্ক নেই তো?
সোজা হলো কিশোর। আমিও এতক্ষণ ধরে এই কথাটাই ভাবছি…
*
রিভারসাইডে পৌঁছে মিস্টার জবারের বাড়িটা খুঁজে বের করতে পুরো একটা ঘণ্টা লেগে গেল ওদের। দুজনে একসঙ্গে এসে দাঁড়াল তার দরজার সামনে।
শহরের দরিদ্রতম এলাকায় বাস করেন। এখানে পুরো ব্লকের সব বাড়িই পুরানো। চাঁদের আলোয় বিচিত্র দেখাচ্ছে, যেন কার্ডবোর্ডের তৈরি ছাউনি সব।
মিস্টার জবারের বাড়িটা আরও বেশি পুরানো। মলিন, বিবর্ণ, হতদরিদ্র চেহারা।
দরজায় থাবা দিল কিশোর। বেশ কয়েকবার থাবা দেয়ার পর দরজা খুলে। দিলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। ছেঁড়া পর্দার ওপাশ থেকে উঁকি দিলেন। বাড়িটার চেহারার সঙ্গে মিল রাখতেই যেন পরনের পোশাকটাও তার অতি পুরানো।
কি? জিজ্ঞেস করলেন জবার।
আমরা আপনার মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি, কিশোর বলল। যাদের সঙ্গে মিশেছিল, তারা আবার জ্বালানো শুরু করেছে। আমরা ওদের শয়তানি বন্ধ করতে চেষ্টা করছি। সেজন্যে আপনার সাহায্য দরকার।
কে তোমরা?
আমার নাম কিশোর। ও রবিন। আমরাও ওদের শয়তানির শিকার। সাংঘাতিক বিপদে ফেলে দিয়েছে। উদ্ধার পেতে চাই।
সারাহকে চিনতে নাকি তোমরা?
না। তবে তার সব কথা জানি। কিভাবে মারা গেছে শুনেছি। মারা যাওয়ার আগে যে লোকটাকে খুন করেছে তার কথাও জানি।
ওই ইবলিসগুলোর সঙ্গে মেশার আগে একটা পিঁপড়ে মারারও ক্ষমতা। ছিল না ওর। কি মেয়েটাকে কি বানিয়ে ফেলল! কেঁপে উঠল বৃদ্ধের কণ্ঠ। এসো। ভাল ছেলে বলেই মনে হচ্ছে তোমাদের। দেখি, কি সাহায্য করা যায়।
মিসেস জবারকে ডিস্টার্ব করব না তো আবার? বিনীত ভঙ্গিতে বলল কিশোর।
না না, ও ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমাচ্ছে। একটু আস্তে কথা বললেই হবে। মেয়েটা মারা যাওয়ার পর থেকেই ঘুম-নিদ্রা একেবারে গেছে বেচারির। কড়া কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয় এখন।
বসার ঘরে ওদেরকে নিয়ে এলেন মিস্টার জবার। বয়েস ষাটের কাছাকাছি হবে। সারাহ্ নিশ্চয় ওদের বেশি বয়েসের সন্তান। কিংবা পালিতা কন্যাও হতে পারে।
রবিন আর কিশোরকে বসতে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, বলো এখন, কি জানতে চাও?
কি করে মারা গেল আপনার মেয়ে? জানতে চাইল কিশোর। সে একাই কথা বলছে। রবিন চুপ করে আছে।
যেদিন মারা গেল সেদিন রাতে ওর ঘর থেকে একটা চিৎকার শুনলাম। মনে হলো প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি বুক চেপে ধরে মেঝেতে গড়াগড়ি করছে সারাহ। বুঝলাম হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাঁচাতে পারল না। বুক চেপে ধরে কাশতে লাগলেন জবার। অবস্থা দেখে মনে হলো যেন তাঁরই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। অনেক কষ্টে কাশি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মেয়ে মানুষ খুন করেছে একথা তোমাদের কে বলল?
মিসেস জোসেফিনা ব্রেক।
বেচারি, একটা সেকেন্ড মুখ নিচু করে রাখলেন মিস্টার জবার। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কাছে কি জানতে চাও?
আপনার মেয়ের যে কোন বন্ধুর নাম, যে ওই শয়তান উপাসকদের সঙ্গে জড়িত ছিল, কিংবা এখনও আছে।
ওর কোন বন্ধু ছিল না। ও ছিল একেবারে একা। নিঃসঙ্গ। এত সুন্দরী ছিল, কিন্তু কোন দিন কোন ছেলেবন্ধু জোটেনি। কোন ছেলে এসে ওর সঙ্গে যেচে বন্ধুত্ব করতে চায়নি। খুব অবাক লাগত আমার। কোন মেয়ে ওকে কখনও ফোন করত না। কেন, কখনও বুঝতে পারিনি। এখনও পারি না। জন্মের পর থেকেই খুব শান্ত ছিল মেয়েটা। হৈ-হট্টগোল পছন্দ করত না। কারও সঙ্গে কথা বলত না। একা একা নিজের মত থাকত। সেই মেয়েটাই শেষে কি হয়ে গেল!
কার সঙ্গে প্রথম মেলামেশা করেছিল, জানেন নাকি? এতক্ষণে একটা প্রশ্ন করল রবিন। কথা তো সে নিশ্চয় কারও সঙ্গে বলেছে। নইলে শয়তান উপাসকদের খপ্পরে পড়ল কি করে?
নাহ, জানি না! ক্ষোভের সঙ্গে জবাব দিলেন মিস্টার জবার। যদি জানতাম এই অবস্থা হবে, তাহলে তো কড়া নজরই রাখতাম। কি করে যে ওই ইবলিসগুলোর সঙ্গে পরিচয় হলো, কিছুই বলতে পারব না।
এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে কয়েকটা বাধানো ছবির ওপর দৃষ্টি আটকে গেল রবিনের। একটা বুকশেলফের ওপর দাঁড় করানো। জবারদের পারিবারিক ছবি।
চেয়ার থেকে উঠে পায়ে পায়ে সেগুলোর দিকে এগিয়ে গেল সে। একটা ছবিতে একা একটা মেয়ে বসে আছে। লাল চুল। সবুজ চোখ। বেড়ালের চোখের মত জ্বলছে। মেয়েটার চোখ দেখলেই মনে হয় মানসিক রোগী। কোন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ এরকম করে তাকায় না। হাত নেড়ে কিশোরকে ডাকল রবিন।