রবিনের দিকে তাকাল কিশোর, চলো। মিসেস ব্রেককে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমরা। ওনার এখন একা থাকা দরকার।…অনেক ধন্যবাদ। আপনাকে, মিসেস ব্রেক। আমাদের দিয়ে যদি কোন রকম সাহায্য হবে মনে করেন কখনও, দ্বিধা-সঙ্কোচ না করে খবর দেবেন।
১৩.
জবারের বাড়ি যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল কিশোর। ইনফরমেশন থেকে ঠিকানা জোগাড় করেছে। কিন্তু রবিন বলল আগে মারলাকে দেখতে যাওয়া দরকার। পার্কের মীটিং থেকে যাওয়ার সময় ওর মনের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল।
মারলাদের বাড়ির সামনে পৌঁছে কিশোরকে গাড়িতে বসতে বলে, দেখতে চলল রবিন। মারলার ঘরের একটামাত্র জানালায় আলো জ্বলছে। বাকি পুরো বাড়িটাই অন্ধকার। বারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। ভেজানো দরজা ঠেলে উঁকি দিল রবিন।
চিত হয়ে শুয়ে আছে মারলা। মৃদু শব্দে মিউজিক বাজছে। রবিনের সাড়া পেয়ে ফিরে তাকাল। চোখ কেমন ঘোর লাগা, লাল টকটকে। মাথার কাছের টেবিলে রাখা একটা আধখাওয়া মদের বোতল। অবাক হলো রবিন। মারলা তো মদ খায় না!
রবিন, বিড়বিড় করল মারলা, তুমি নাকি?
কেন দেখতে পাচ্ছ না? এগিয়ে গিয়ে বিছানার কাছে দাঁড়াল রবিন। কি। হয়েছে তোমার?
ছাতের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মারলা। কি হয়েছে? কিছুই না। খুব ভাল আছি আমি। ড্যানির যা অবশিষ্ট আছে, কাল নিয়ে আসবে। ওর মা আমাকে ফোন করে অনুরোধ করেছেন, একটা বাক্স কিনে নিয়ে যেতে পারব কিনা। ভাবতে পারো? দুই হপ্তা আগে রাস্তায় দেখে জোর করে বাজারে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে, পছন্দ করে ড্যানিকে একটা প্যান্ট কিনে দেয়ার জন্যে। কাঁদতে শুরু করল সে। কথা জড়িয়ে গেল। আর এখন এল কফিন কিনে দেয়ার অনুরোধ।
ওর বাহুতে হাত রাখল রবিন। ড্যানির জন্যে তোমার চেয়ে কষ্ট আমার কম হচ্ছে না, মারলা। ও আমার বন্ধু ছিল। তত্ত্বাবধায়কের শয়তানি আমরা বন্ধ করবই। প্রতিশোধ নেব। কিশোর আর আমি অনেকখানি এগিয়ে গেছি। মরুভূমিতে পড়ে থাকা লোকটার মায়ের সঙ্গে কথা বলে এলাম
কোন আগ্রহ বোধ করল না মারলা। তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে লেগে সুবিধে করতে পারব না আমরা। বরং যা করতে বলে করে ওর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া উচিত।
না, ওর কথা শুনব না আমরা।
শোনাই উচিত! নইলে সোফি আর ড্যানির অবস্থা হবে। বাঁচতে হলে ওর কথা শুনতেই হবে, ব্যথায় ককিয়ে উঠল মারলা। কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ল। বোতলটার দিকে বাঁ হাত বাড়াল, যদিও ডান হাত দিয়েই নেয়ার সুবিধে বেশি।
টান দিয়ে বোতলটা সরিয়ে ফেলল রবিন। অনেক খেয়েছ। ঘুমাও। এখন। কাল সকালে এসে দেখে যাব আবার।
বোতলটা দেয়ার জন্যে অনুরোধ করতে লাগল মারলা। নিজে উঠে রবিনের হাত থেকে কেড়ে নেয়ারও যেন শক্তি নেই। বাঁ হাতটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দাও, প্লীজ!
বারবার বা হাত বাড়াতে দেখে অবাক হলো রবিন। সন্দেহ হলো ওর। একটানে মারলার গায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে ফেলল।
মারলার ডান হাতে ব্যান্ডেজ বাধা। আনাড়ি হাতে বেঁধেছে। রক্তে ভিজে গেছে। রক্ত লেগে গেছে হাতটা বিছানার যেখানে ফেলে রেখেছিল সেখানকার চাদরে।
ডান হাতের তর্জনীটা নেই দেখাই যাচ্ছে।
মারলা! চিৎকার করে উঠল রবিন। তুমি কি মানুষ! করলে কি করে একাজ! নিজের আঙুল নিজে কেটে ফেললে!
উঠে বসল মারলা। চোখেমুখে রাগ আর ভয় একসঙ্গে ফুটেছে। আর কি। করতে পারতাম? একটা আঙুলই তো শুধু গেছে। যাক। প্রাণটা তো বাচল। জানো, খুব একটা কষ্ট হয়নি। ভালমত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নিলাম। তারপর ধারাল ছুরি দিয়ে কষে এক পোচ। ব্যস, গেল আলগা হয়ে। চিঠিটার সঙ্গে একটা খামে ভরে রেখেছি…,
থামো! আর শুনতে চাই না!
থামল না মারলা। ওটা এখন নিয়ে যেতে হবে ক্লডিয়ার কাছে। বিজ্ঞপ্তিতে তাই বলেছে। ডাকে তো আর পাঠানো যাবে না। রক্ত দেখলেই সন্দেহ করবে। কি আর করব? নিজেকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে। খামটা একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিয়ে যাব।
কাজটা করা তোমার মোটেও উচিত হয়নি…
এটাই উচিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক মানুষ না। পিশাচ! সোফি আর ড্যানির কি দুর্গতি করেছে দেখলেই তো। যেখানে খুশি যেতে পারে সে। যা ইচ্ছে করতে পারে। এর পরেও ওকে ঘটানোর সাহস হবে? কথা না শুনলে। কি ঘটত বুঝেই একাজ করেছি। টুকরো টুকরো হয়ে কিংবা ছাই হয়ে মরার চেয়ে একটা আঙুল খোয়ানো অনেক ভাল।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে রবিন বলল, কি জানি কোনটা ভাল! কিন্তু এখন তুমি ওই শয়তানের তারকায় ঢুকে পড়েছ।
তাতে কি হয়েছে? একটা আঙুলের বিনিময়ে বেঁচে তো গেলাম।
কি জানি বাচলে না আরও মরলে! একদিন হয়তো আরও বেশি পস্তাতে হতে পারে এর জন্যে।…ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব? যাবে?
অদ্ভুত দৃষ্টিতে রবিনের দিকে তাকাল মারলা। সাহায্য লাগবে না। আমি নিজেই গাড়ি চালাতে পারব। মাত্র তো একটা আঙুল গেছে। বাকি নয়টাই এখনও ঠিক। তুমি কি ভেবেছ একটা আঙুল বাদ যাওয়াতেই পঙ্গু হয়ে গেছি আমি?
তোমার আব্বা-আম্মাকে ডাকব?
আহ, বললাম তো আমার কোন সাহায্য লাগবে না, বিরক্ত হলো। মারলা। এখন ওদের দেখালে হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দেবে। যে জন্যে নিজের আঙুল খোয়ালাম, সেটাও আর করতে দেবে না। কথার অবাধ্য না হয়েও তত্ত্বাবধায়কের আক্রোশ থেকে বাঁচতে পারব না তখন। বরং সকলেই জানুক। ততক্ষণে ব্যথাও শুরু হবে, তত্ত্বাবধায়কের ফাঁদ থেকেও বেরিয়ে আসব। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলে নিজেই যেতে পারব… তুমি যাও। এখানে কিছু আর করার নেই। বোতলটা দিয়ে যাও দয়া। করে।