কয়েক দিন আর বাড়ি থেকেই বেরোল না ডেভি। একদিন মায়া এসে হাজির হলো। ডেভির চেয়ে দুতিন বছরের ছোট হবে। খুব সুন্দরী। ডেভির সঙ্গে ফিসফাস করে কি সব বলল। সন্দেহ হলো আমার। ওরা গাড়িতে করে বেরিয়ে যেতেই আমিও গাড়ি নিয়ে পিছু নিলাম।
বড় একটা গুদামের মত বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল ওরা। খানিক দূরে গাড়িতে বসে রইলাম। ঘন্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে গেল। রাত হলো। তখনও ওদের বেরোনোর নাম নেই। আমার আশেপাশে যে সেব লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখলাম, একটাকেও ভাল লোক বলে মনে হলো না। সব গুণ্ডাপাণ্ডা। ভয় পাচ্ছিলাম রীতিমত। রাত বারোটা পর্যন্ত বসে থেকে আর থাকার সাহস হলো না। বাড়ি না ফিরে চলে গেলাম আমার বোনের বাড়িতে। কি করা যায় ওর সঙ্গে পরামর্শ করতে।
পরদিন পুলিশ নিয়ে গেলাম ওই গুদামে। দুজন অফিসার ভেতরে ঢুকল। আমি বসে রইলাম বাইরে, পুলিশের একটা পেট্রল কারে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এল অফিসার দুজন। মুখ সাদা। একজন রাস্তার ধারে দেয়ালের কাছে গিয়ে বমি শুরু করল। অন্যজন আমাকে জানাল, ভেতরে কেউ নেই। তবে যা আছে দেখলে সহ্য করতে পারব না। ভাবলাম ডেভির কিছু হয়েছে। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ঢুকে পড়লাম গুদামে।
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলার পর দম নেয়ার জন্যে থামলেন মিসেস ব্রেক।
শয়তান উপাসকদের আস্তানা ছিল ওটা, তাই না? শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ভুরু কোচকালেন মিসেস ব্রেক, তুমি জানলে কি করে?
আপনার কথা শুনে। ওভাবে জন্তু-জানোয়ার বলি দিয়ে উপাসনা করে শয়তান উপাসকরাই। বলি দেয়ার জন্যে মানুষ তো আর সহজে মেলে না আজকাল যাই হোক। কি দেখলেন?
দৃশ্যটা কল্পনায় ভেসে উঠতে চোখমুখ বিকৃত করে ফেললেন মিসেস ব্রেক। কি যে ভয়াবহ দুর্গন্ধ ছিল ওখানে, বলে বোঝাতে পারব না। সব জায়গায় রক্ত, কোথাও শুকনো, কোথাও আধাশুকনো, কোথাও প্রায় তাজা। পশুর চামড়া আর নাড়ীভুড়ি ছড়িয়ে আছে সবখানে। বিচিত্র সব নকশা এঁকে রেখেছে মেঝেতে। কোনটা বৃত্ত, কোনটা পাঁচ কোণওয়ালা তারকা, কোনটা ছয় কোণ। ওগুলোর মধ্যে দুর্বোধ্য নানা রকম চিহ্ন আঁকা। কোন কোনটার মধ্যে নামও লিখেছে। সবই রক্ত দিয়ে। কালো রঙের আধপোড়া প্রচুর মোমবাতি পড়ে আছে মেঝেতে। কয়েক সেকেন্ডের বেশি ছিলাম না, কিন্তু তাতেই মাথা ঘুরতে শুরু করল আমার। মনে হলো পাগল হয়ে যাব। ছুটে বেরিয়ে এলাম বাইরে। অফিসাররা আমাকে নানা ভাবে শান্ত করার চেষ্টা করল। ডেভির জন্যে কষ্টে মনটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। এত ভাল স্বভাবের একটা ছেলে আমার এ কাদের সঙ্গে মিশল! ওরা শুধু খারাপ নয়, ভয়ানক খারাপ, নরকের ইবলিস! ছেলের আশা ছেড়ে দিলাম।
তারমানে শয়তান উপাসকদের কাণ্ডকারখানা অজানা নয় আপনার? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল কিশোর।
মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ব্রেক। না। বইতে পড়েছি।
আপনার ছেলেকে ওরা পটিয়ে-পাটিয়ে বলি দেয়ার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল।
আবারও মাথা ঝাঁকালেন মিসেস বেক। চোখে পানি টলমল করে উঠল আবার।
বলো কি! আঁতকে উঠল রবিন। এই যুগে খোদ আমেরিকা শহরে নরবলি!
ফিরে তাকাল কিশোর। আমেরিকা হলে কি হবে? মানুষের চরিত্র হতো। আর বদলায়নি। আদিম যুগেই রয়ে গেছে। বিবেক-বুদ্ধি বেশি যাদের, তারা জোর করে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে নিজেকে। যারা পারে না…যাকগে, মিসেস ব্রেকের দিকে তাকাল কিশোর, তারপর কি হলো?
মায়া হলো একজন শিক্ষানবীস, মিসেস ব্রেক বললেন। পুরোপুরি ডাইনী হতে হলে শুধু পশু বলি দিলে চলবে না, নরবলি দিতে হবে। শয়তান। উপাসকদের বিশ্বাস, যে যত বেশি মানুষ খুন করতে পারবে, কিংবা অন্যকে প্ররোচনা দিয়ে তার সাহায্যে ছলে-বলে-কৌশলে খুন করাতে পারবে, সে তত বেশি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে। বলি দেয়া আত্মাগুলো দখলে চলে আসবে তার। যে যত বেশি নিষ্ঠুর হবে, আত্মাগুলো তার আদেশ তত বেশি পালন করবে। আমার ছেলেকে বোকা পেয়ে প্রথম শিকার হিসেবে তাকে নির্বাচিত করেছিল মায়া।
কি করে জানলেন? জিজ্ঞেস করল রবিন। মায়ার সঙ্গে কথা বলেছিলেন? নাকি ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছেন?
মিসেস ব্রেকের এক চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। মোছার চেষ্টা করলেন না তিনি। ধরা গলায় বললেন, ওর সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি আমার। গুদাম থেকে পালানোর দুদিন পর একদিন রাতদুপুরে ফোন। করল আমাকে। কেমন আছি জিজ্ঞেস করল। ওটাই তার সঙ্গে শেষ কথা। আর কথাও হয়নি, দেখাও না। নিখোঁজ হয়ে গেল।
মায়াকে জিজ্ঞেস করেননি ও কোথায় গেল?
না। তবে ওর বাবা-মার সঙ্গে দেখা করেছি।
কোথায়? গলা লম্বা করে সামনে মুখ বাড়িয়ে দিল কিশোর। কখন?
মর্গে। ওদের মেয়েকে শনাক্ত করতে এসেছিল।
মায়াও মারা গেছে!
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ব্রেক। হ্যাঁ। শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে তোমাদের, কিন্তু তবু বলি, ও মরাতে আমি খুশি হয়েছি। বেঁচে থাকলে আমার ছেলের মত আরও কত ছেলের যে সর্বনাশ করত কে জানে। যা হোক, আমি সেদিন গুদামে পুলিশ নিয়ে গিয়ে দেখে আসার পর কি ঘটল বলি। গুদামটার ওপর সাদা পোশাকে নজর রাখল গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু শয়তান উপাসকদের কেউ আর ফিরে এল না সেখানে। মায়ার নাম বললাম পুলিশকে। শুধু নামটাই জানাতে পেরেছিলাম, তখনও ওর পরিচয় জানতাম না। নাম আর চেহারার বর্ণনা।