আপনাকে খবর দেয়ার কথা ভেবেছি আমরা, রবিন বলল। লোকটা কে, কোথায় বাস করে, কিছুই জানতাম না। জানলে খবরটা ঠিকই দিতাম, যেভাবেই হোক। এই যে, জানার পর পরই চলে এলাম, একটুও দেরি করিনিঃ…ওর বাড়িতে কি করে খবর দেয়া যায় সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমরা। একবার মনে করলাম পুলিশকে একটা উড়োচিঠি দিয়ে জানিয়ে দিই অমুক জায়গায় অমুক দিন একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। লাশটাকে অমুক জায়গায় কবর দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও ভয় ছিল খোঁজ করতে করতে ঠিকই আমাদের হদিস করে ফেলবে পুলিশ। দম নেয়ার জন্যে থামল সে।
সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, আবার বলল রবিন, ওকে খুন করতে চাইনি আমরা। কিভাবে গাড়ির নিচে চলে এল সেটা এখনও মাথায় ঢুকছে না আমার। লাশটা দেখার পর মনে হয়েছিল, রাস্তার ওপর শুয়ে ছিল আপনার ছেলে। বেহুশ হয়ে। অন্ধকারে স্রেফ তার ওপর দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে দেয়া হয়েছে। চাকার নিচে কিছু পড়েছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলে আমার বন্ধু ড্যানি। নিচে নেমে দেখি কি আর বলব! মিসেস ব্রেক, আপনার ছেলেকে খুন করেছি আমরা। যে কোন শাস্তি দিতে পারেন। আমাদের। ইচ্ছে করলে এখনই পুলিশে ফোন করে আমাকে ধরিয়ে দিতে পারেন।
রবিনকে অবাক করে দিয়ে তার বাহুতে হাত রাখলেন মহিলা। বিশ্বাস করতে পারল না সে। রেগে ওঠার বদলে সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। আশ্চর্য!
ওর লাশের কি হলো এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি, মিসেস ব্রেক বললেন। রোজ রাতেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, কোথায় পড়ে আছে লাশটা? জানতাম মারা গেছে ও। কে খুন করেছে তা-ও জানি। তোমরা ওকে খুন করোনি, রবিন। অহেতুক কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই। ওর লাশের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়েছিল তোমার বন্ধু। তোমাদের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা। যায়নি। আগেই খুন হয়ে গিয়েছিল।
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। কিশোর নির্বিকার। রবিন তাকাতেই চোখ টিপল। অর্থাৎ, কি, বলেছিলাম না?
কফির কাপটা নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিলেন মিসেস ব্রেক। পুরো ব্যাপারটা তোমাদের খুলেই বলি। খুব মানসিক কষ্টে আছ তোমরা, বোঝা যাচ্ছে। কপালে হাত ডললেন তিনি। তোমাদের সব বলতে পারলে আমারও মনটা খানিক হালকা হবে।
চুপ করে রইল ওরা। শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে।
কপাল থেকে হাত নামালেন মিসেস ব্রেক। কোন্খান থেকে শুরু করব? প্রথম থেকেই বলি সব। ভালই চলছিল আমাদের মা-ছেলের সংসার। ঠিকমত দোকানে যেত ডেভি, ব্যবসা করত, ঠিকমত বাড়ি ফিরত। কোন রকম বদনেশা ছিল না। রাতে খাবার টেবিলে সারাদিন যা যা করত সব আমাকে বলত। একরাতে হঠাৎ করেই মেয়েটার নাম বলল। প্রায়ই আসত সিডি ডিস্ক কিনতে। উদ্ভট গান তার বেশি পছন্দ। মেয়েটার নাম মায়া। তেমন গুরুত্ব দিলাম না। দোকানে কত ধরনের কাস্টোমারই আসে। সবার গানের রুচিও একরকম না। এটা নিয়ে মাথা ঘামালাম, না। তবে ঘামানো উচিত ছিল। তাহলে হয়তো আজ আমার ডেভি বেঁচেই থাকত।
বদলাতে শুরু করল ডেভি। অসহিষ্ণু, বদমেজাজী হয়ে উঠল। কারণে অকারণে আমার সঙ্গে খেচাখেচি শুরু করে দিত, আগে যেটা সে কখনোই করত না। ওর এই পরিবর্তনে শঙ্কিত হলাম আমি। অনিদ্রা রোগেও ধরল ওকে। দোকান থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরতে লাগল। তারপর একদিন আর ফিরলই না। দুদিন কোথায় কাটিয়ে ফিরে এল। বুঝলাম কোন মেয়ের পাল্লায়। পড়েছে। সেই মেয়েটাও হতে পারে, মায়া। ভাবলাম, পড়ে পড়ুকগে। জোয়ান বয়েসী ছেলে। পড়বেই। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করাতে যখন এড়িয়ে গেল, সন্দেহ হলো আমার।
তারপর একদিন বাথরূমে তাকে কোকেনের প্যাকেট বাছাই করতে দেখে ফেললাম। কলজে কেপে গেল আমার। গানের জগতে হেরোইন আর অন্যান্য নেশায় জড়িয়ে যাওয়াটা একটা অতি সাধারণ ব্যাপার, জানা আছে আমার। এই বিষ যে কোথায় নিয়ে যায় মানুষকে, তা-ও জানা। সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেলাম। একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে সর্বনাশ ঠেকানোর কোন পথই আর খোলা থাকবে না। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর দোকানের ভার ওর ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কোন গণ্ডগোল করেনি কখনও, তাই হিসেব নেয়ার কথাও ভাবিনি। সেদিন ভাবলাম। হিসেব নিতে গিয়ে দেখি কিছুই নেই। সব খুইয়ে বসে আছে। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট শূন্য। আমি একটা স্কুলের টীচার। দোকানদারি না করলেও চলে যাবে মা-ছেলের। তাই দোকানের জন্যে চিন্তা না করে আগে ছেলের দিকে নজর দিলাম। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলাম ওকে। প্রথমে রাজি হতে চাইল না। আমিও লেগেই রইলাম। শেষমেষ আমার চাপাচাপিতে ক্লিনিকে যেতে যেদিন রাজি হলো, সেদিন এমন। একটা জিনিস দেখে ফেললাম, বুঝলাম ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েও আর লাভ নেই।
বাগানে ফুলগাছের পাতা ছাটতে গিয়ে পচা গন্ধ লাগল নাকে। খুঁজতে খুঁজতে দেখি একটা ঝোপের ধারে নতুন গর্ত। মাটি চাপা দেয়া। অল্প একটু খুঁড়তেই বেরিয়ে পড়ল সবুজ একটা পলিথিন ব্যাগ। তার ভেতরে তিনটে জানোয়ারের ধড়, মাথা কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে–কুকুর, বেড়াল এমনকি একটা খটাশও আছে। গায়ের চামড়া জায়গায় জায়গায় কামানো। ডেভিকে জিজ্ঞেস করলাম। অস্বীকার করল না ও।
আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখালাম ওকে। কাকুতি-মিনতি শুরু করল। বলল সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে আবার ভাল হয়ে যাবে। আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না জানতাম, সেজন্যেই ভয় দেখিয়েছিলাম। কোন বদমাশদের দলে যোগ দিয়েছে জিজ্ঞেস করলাম। বলে দিল সব। ওই মেয়েটাই ওর সর্বনাশ করেছে।