একটা কথা সত্যি করে বলো তো। মানুষ জাতটাকে কি তুমি পছন্দ করো না?
করব না কেন? নিজেও তো মানুষ। মানুষের স্বভাব জানার এত আগ্রহ কেন আমার জানো? ওদের সাহায্য করার জন্যে। মানুষ যেসব অপরাধ করে, কেন করে সেটা যদি না জানো, ভাল গোয়েন্দা তুমি কোনদিনই হতে পারবে না।
একটা কম্পিউটারের সামনে গিয়ে বসে পড়ল কিশোর। নিখোঁজ মানুষদের ফাইলটা খোলার নির্দেশ দিল কম্পিউটারকে। যতটা সময় লাগবে ভেবেছিল রবিন, ফাইল খুলতে তারচেয়ে বেশি সময় লাগিয়ে দিল কম্পিউটার। ফাইলগুলো সব একজায়গায় নেই। বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সবগুলোকে জোগাড় করে একখানে এনে খুলতে সময় লাগবেই। অপেক্ষা করতে হবে।
নামগুলো সব লাইন দিয়ে ফুটে উঠলে এক এক করে বাছাই শুরু করল কিশোর। রাশি রাশি নাম থেকে বাছাই করে রাত এগারোটায় ছয়টা নামে এনে ঠেকাল। কমে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দুজনেই।
এবার কি করবে? জানতে চাইল রবিন।
দুটো কাজ, দুই আঙুল তুলল কিশোর। এক, ফোন বুক দেখে ঠিকানা জেনে নিয়ে ওদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব। হয়তো দেখা যাবে ছয়জনের মধ্যে কয়েকজনই আর নিখোঁজদের মধ্যে নেই, বাড়ি ফিরে গেছে। তালিকা থেকে বাদ যাবে ওরা। আরও কমে আসবে নিখোঁজের সংখ্যা। দ্বিতীয় কাজটা করতে পারি পত্রিকা দেখে। বিজ্ঞাপনের পাতার নিখোঁজ সংবাদে ওদের নাম-ঠিকানা দিতে পারে। তাতে সময় লাগবে অনেক বেশি। মাইক্রোফিল্ম করে কম্পিউটারে ভরে রাখা প্রতিটি পাতা দেখে দেখে ওই ছয়জনের নাম-ঠিকানা বের করতে সারারাতও লেগে যেতে পারে। তারপরেও কথা আছে, যদি পত্রিকায় থাকে। নইলে কষ্টটাই সার হবে।
কিন্তু এখন তো বাজে রাত এগারোটা। এত রাতে মানুষের বাড়িতে ফোন করবে?
উপায় কি? সময় এখন অতি মূল্যবান। কথা না বলে এসো হাত লাগাও। সেরে ফেলি। পত্রিকায় খোঁজার চেয়ে ডিরেক্টরিতে খোঁজাই সহজ হবে।
আসলেই সহজ হলো। পনেরো মিনিটেই ছয়জনের মধ্যে চারজনেরই ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল। দেরি না করে ফোন শুরু করল। প্রথমজন কিশোর দুটো কথা বলার আগেই ফোন রেখে দিল। দ্বিতীয়জন মহিলা। নিখোঁজ লোকটার কথা বলতেই কাঁদতে শুরু করল। শিকারে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল তার স্বামী। কয়েকদিন পর ভালুকের গুহার সামনে পাওয়া যায় তার। ক্ষতবিক্ষত লাশ। তৃতীয়জনও মহিলা। তার বাড়ির নিখোঁজ লোকটার কথা জিজ্ঞেস করতেই রেগে উঠল। জানাল, আরেক মহিলার কাছে চলে গেছে। তার স্বামী। খোঁজ পাওয়া গেছে। চতুর্থ নম্বরটায় রিঙ হয়েই চলল, হয়েই চলল। ধরল না কেউ।
কয়েকবার চেষ্টা করে রিসিভার রেখে দিল কিশোর। মনে হয় বাড়ি নেই। দেখা যাক, খানিক পরে আবার করব।
বাকি দুজন?
নামের তালিকার দিকে তাকাল কিশোর। ডেভন ব্রেক আর ইয়ান জোসেফ। ডিরেক্টরিতে তো পেলাম না।
ভুরু নাচাল রবিন, কি করবে?
ডিরেক্টরিতে যখন পেলাম না, পত্রিকাতেই দেখতে হবে।
খুব বেশিক্ষণ লাগল না প্রথম নামটা বের করতে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ডেভন ব্রেকের ওপর লেখা একটা প্রতিবেদন পেয়ে গেল রবিন। ছবি সহ। দেখেই চোখ কপালে। সেই চেহারা। মরুভূমিতে চিত হয়ে পড়ে থাকা লাশের মুখটা ভেসে উঠল কল্পনায়। একই পোশাক। তামাটে রঙের স্পোর্টস কোট। যেটা সহ ওকে কবর দিয়েছিল ওরা। ছবির সঙ্গে লাশটার তফাত কেবল ওটার ঠোঁটের কোণে রক্ত ছিল, এটার নেই। কম্পিউটারের পর্দার, দিকে কাঁপা কাঁপা তর্জনী তুলে প্রায় ফিসফিস করে বলল, এই সেই লোক!
তুমি শিওর?
ঢোক গিলল রবিন, এই চেহারা জীবনে ভুলব না।
প্রতিবেদনটা একই সঙ্গে পড়তে শুরু করল দুজনে। লিখেছে:
‘ব্যবসায়ী নিখোঁজ
তেত্রিশ বছর বয়স্ক ডেভন ব্রেক, একজন দোকানদার, সাত দিন ধরে নিখোঁজ। সান্তা মনিকার স্থায়ী অধিবাসী তিনি। দোকানটা তাঁর বাবার। প্রায় বাইশ বছর চালিয়েছেন। গানের ক্যাসেট, রেকর্ড, এসব বিক্রি হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর ছেলে দোকান চালাত। তাঁর মা মিসেস ড্রেক একজন টীচার। অবসরে সমাজ-সেবার কাজ করেন। ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াতে বড়ই দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। হুট করে কোথায় গেছে, বা কোথায় যেতে পারে তাঁর ছেলে, এ সম্পর্কে কোনই ধারণা নেই তার। ওয়েস্টউড বুলভারে তাদের বাড়ি। গত দশ বছর ধরে সমাজ-সেবার কাজ করে আসছেন মহিলা। তাদের বিরুদ্ধে। কখনও কোন অভিযোগ শোনা যায়নি, কেউ কখনও বদনাম করেনি। ডেভন ব্রেকের কোন খোঁজ যদি কারও জানা থাকে, দয়া করে নিচের ঠিকানায় খবর দিলে বাধিত হবেন মিসেস ব্রেক।‘
চেয়ারে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল রবিন, তারমানে ভাল মানুষটাকে খুন করলাম আমরা।
তোমরাই তার মৃত্যুর কারণ কিনা এখনও জানো না, কিশোর বলল। বলেছি না, এমনও হতে পারে আগেই তাকে কেউ খুন করে নিয়ে গিয়ে মরুভূমির ধারের ওই রাস্তায় ফেলে এসেছিল।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে রবিন বলল, গোপনে ওকে কবর দেয়াটা যে কত দিক থেকে ভুল হয়ে গেছে: ইস! পুলিশকে যদি জানাতাম, মহিলা জেনে যেতেন এতদিনে তার ছেলের কি হয়েছে। ইস্, মহিলা নিশ্চয় রোজ ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকেন। তার ছেলে আর কোনদিনই ফিরে আসবে না জানলে এই পথ চাওয়ার কষ্ট থেকে বাঁচতেন।
আমার কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছে না লোকটাকে তোমরা খুন করেছ। ও চাপা পড়ার সময় চিৎকার শুনেছ?